নারায়ণগঞ্জ  সোমবার | ২০শে মে, ২০২৪ | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ গ্রীষ্মকাল | ১১ই জিলকদ, ১৪৪৫

শিরোনাম
  |   রূপগঞ্জে  নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন  চেয়ারম্যান প্রার্থী হাবিব   |   মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদে নাসিক প্যানেল মেয়র বাবুর সংবাদ সম্মেলন   |   রূপগঞ্জে হত্যাসহ ১৮ মামলার আসামির তান্ডবে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী   |   বন্দরে জাপা নেতা সুমন প্রধানের বিরোদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ   |   জমিদারতন্ত্র কায়েম করতে আ’লীগ আমি-ডামির নির্বাচন করেছে – জোনায়েদ সাকি   |   বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলার ৮ম কমিটি গঠন   |   ফিলিস্তিনের মুক্তির লড়াইয়ে সংহতি জানিয়ে ছাত্র ফেডারেশন উদ্বোধন   |   বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলার ৮ম সম্মেলন ১৭ মে   |   ১৭ মে এন পি সি’র যুগপূর্তিতে আলোকচিত্রের ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোচনা   |   উপজেলা পরিষদ নির্বাচনআদালতকে হয়রানী করায় সেলিম প্রধানকে জরিমানা   |   বাবুরাইল খেলার মাঠ দখলে তদন্ত করে ব্যাবস্থাগ্রহনের নির্দেশ দিলেন পুলিশ সুপার   |   ১৭ মে গুলশান সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পাবে পটু সিনেমা | সারা ফেলার প্রত্যাশা   |   প্রতারকদের কাছ থেকে বাবুরাইল খেলার মাঠের জমি যারা কিনছেন, ভুল করেছেন   |   পাগলায় ট্রেনে কাটা পড়ে বন্দরের টেলু’র মৃত্যু   |   বন্দরে ৪টি স্কুলের শিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন   |   রূপগঞ্জে নকল মশার কয়েলে সয়লাব | স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে জনজীবন   |   গিয়াস উদ্দিনের জামিন না-মঞ্জুরে ফতুল্লা থানা বিএনপির তীব্র নিন্দা   |   করোনার রিপোর্ট করায় চীনা সাংবাদিক ৪ বছর জেল খেটে মুক্তি পাচ্ছেন   |   নারী কাউন্সিলরকে মারধরের অবিযোগে  কাউন্সিলর সামসুজ্জোহা বরখাস্ত    |   ভেজালবিরোধী অভিযানে চার প্রতিষ্ঠানকে ৩২ হাজার ৫শ টাকা জরিমানা
 প্রচ্ছদ   মন্তব্য প্রতিবেদন   গার্মেন্টস শ্রমিক অভ্যুত্থানে আমাকে গ্রেফতারে হাজার শ্রমিকের থানা ঘেড়াও
 36
গার্মেন্টস শ্রমিক অভ্যুত্থানে আমাকে গ্রেফতারে হাজার শ্রমিকের থানা ঘেড়াও
  মন্তব্য প্রতিবেদন || নারায়ণগঞ্জেরখবর.কম
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০২২
লেখক, এ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান ইসমাইলঃ  

শিল্প নগরী নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক আন্দোলনের সু-বিশাল ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন সুতাকল-পাটকল এর সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা উত্তর শীতলক্ষ্যা পাড়ের কলকারখানার আন্দোলই ছিল বড় বড় জন সমাবেশ-মিছিল-মিটিং এর প্রধান শক্তি। আদমজী জুট মিল্স ছিল বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের সুতিকাগার। পায়ে হেঁটে নারায়ণগঞ্জ থেকে পল্টন ময়দানের সামাবেশ গুলো কানায় কানায় ভরে তুলতো এই পাট কল শ্রমিকরা। প্রতিথযশা শ্রমিক নেতৃত্ব ছিল এই আন্দোলন গুলোর প্রানের উৎস। স্বাধীনতা পরবর্তী এই সকল কলকারখানা এবং বিআইডব্লিউটিএ, আইডব্লিউটিএ, রেল শ্রমিক, নৌ-যান শ্রমিক, ডকইয়ার্ড সহ ব্যক্তি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিল্প কারখানায় বিশেষ ভাবে হোসিয়ারী, সুতাকল, পাটকল, এবং ষ্টিল রি-রোলিং শ্রমিক আন্দোলনে তোলারাম কলেজের ছাত্র আন্দোলনে আমি একজন সংগঠক হিসেবে যুক্ত থাকতেই শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত হয়ে পড়ি। শ্রমিকদের পাশে কথা বলতে যেয়ে ঐ সময়েই তিন বার আমাকে জেলে আটক থাকতে হয়েছিল। ঐ সময়ে নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠছিল এবং বেড়ে উঠছিল। এক পর্যায়ে পাট শিল্পের পরবর্তী স্থান দখল করে নেয় গার্মেন্টস শিল্প কারখানা। এই শিল্পের সহযোগী সুতা-বুতাম, মেশিনারীজ, ওয়েস্টেজ কাটাকাপড় ইত্যাদি ব্যবসার এক বিশাল বাজার গড়ে উঠে। এই গার্মেন্টস অতি দ্রুত বিকাশ গঠতে থাকলেও এর পরিপূরক শ্রমনীতি বা শ্রম আইন উপেক্ষিত হয় মালিকদের দ্বারা। অধিক মুনাফার এক নিষ্ঠুর সংস্কৃতি গড়ে উঠে গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যে। মালিক পক্ষের গঠিত সংগঠন বিকেএমইএ শ্রমিকদের দাবি-অধিকার লঙ্ঘিত হতে থাকে। ক্রমাগত ভাবে শ্রমিক অধিকার ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে এমন অবস্থা হয় যে, বি ত শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে মনোযোগ দেয়া বা কিছু করার মত আর কেহ থাকে না। কথায় কথায় শ্রমিক ছাটাই,  ২/৪ মিনিট দেরী করে গেলে হাজিরা কেটে দেয়া,  সাপ্তাহিক ছুটি না দেয়া, একদিন এব্সেন্ট করলে ৩ দিনের হাজিরা কেটে দেয়া, অসুস্থ হলে ছুটি না দেয়া, কর্মদিবস ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ১২/১৪ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা, নারী শ্রমিকদের রাত্রিকালীন কাজে বাধ্য করা, শিপ্মেন্টের নামে একটানা ৩/৪ দিন ফ্যাক্টরিতে আটকে রাখা। সময় মতো বেতন না দিয়ে ঘুরানো। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা। এক কথায় দীর্ঘদিন যাবৎ মুনাফা লোভী গার্মেন্টস মালিকদের অমানবিক শোষণের কারণে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ঘণিভূত হয়ে তখন চরম আকার ধারণ করেছিল। এছাড়াও ৫-৬ মাস যাবৎ ফতুল্লার পলমল গার্মেন্টস, বিসিকের ফকির এ্যাপারেল্স, সামস্ রেডিওয়্যার, এসি বাংলা, ক্রোনি গার্মেন্টস, তামান্না গার্মেন্টস, জি,আর, ফ্যাশনসহ বহু কারখানায় শ্রমিকেরা নিজেদের দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে আসছিল।

এদিকে ডিউটির ফাঁকে-ফাঁকে এবং সাপ্তাহিক ছুট পেলে অথবা কাজ শেষে রাতে গার্মেণ্টস শ্রমিকেরা আমার সাথে তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা সবসময় জানাতো। এমনিভাবে শ্রমিকেরা আমার সাথে সার্বক্ষণিক ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক যোগাযোগ রাখার মধ্য দিয়ে এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আন্দোলনমুখী এক কারখানার শ্রমিক অন্য কারখানার শ্রমিকদের সাথে পরিচয় গড়ে তোলার সুযোগ পায়। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকায় আন্দোলনমুখী শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার এক ধরনের কমরেড সুলভ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
৮ ঘন্টা কর্ম দিবস, ওভার টাইমের মজুরী সহ ১৮ দফা দাবীতে ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীর প্যানটেক্স ড্রেসি লি: গার্মেন্টস এর গেটের সামনে একটানা তিনদিন যাবৎ শ্রমিকেরা অবস্থান ধর্মঘট করে আসছিল।
২রা নভেম্বর ২০০৩ এর রাতে প্রশাসন বিসিকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে; হঠাৎ সেখানে ৩ জন ম্যাজিষ্ট্রেট উপস্থিত হয়ে মালিকের শিপ্মেন্ট খালাস করার জন্য একেবারে ব্যাকুল হয়ে উঠে। এজন্য তারা  আন্দোলনরত শ্রমিকদের সাথে বৈঠকের নামে নানা প্রকার আশ্বাস দিতে থাকে। অতীতে মালিকদের আশ্বাসের নামে ধোঁকাবাজির অভিজ্ঞতা এবং মালিকদের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে আন্দোলনকারী শ্রমিকরা আমার উপস্থিতি ছাড়া মালিক প্রশাসনের সাথে কোন বৈঠক করতে রাজি না হওয়াতে, রাত সোয়া ১১ টার দিকে মোবাইল ফোনে ওসি ফতুল্লা আমাকে বলেন-আন্দোলনরত শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করার জন্য তারা আমাকে সহ বসতে চায়। আমি তখন তাকে বলি, আগের দিন বিকাল ৫টায় ঐ কারখানার মধ্যেই মালিক শ্রমিক দ্বি-পাক্ষিক ৫ ঘন্টার বৈঠকে শ্রমিকদের পক্ষে আমি ছিলাম। মালিক শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিটি মেনে না নেওয়ার কারণে সমস্যার সমাধান হয় নাই। তখন ঐ পুলিশ অফিসার অধিক আগ্রহে আমাকে বলেন, আপনি যদি এখন আসেন, তবে পুনরায় আলোচনা করে ৮ ঘন্টা কর্মদিবস সহ ১৮ দফা দাবির নিশ্চিত সমাধান করা হবে। তার সামনে বসা তিনজন ম্যাজিষ্ট্রেট (এন.ডি.সি) সৈয়দ বেলাল হোসেন, মাজারুল মান্নান ও প্রকাশ কান্তি তাদের নাম পরিচয় দিয়ে, একের পর এক আমার সাথে কথা বলেন। তারা মালিকের সাথে কথা ফাইনাল করার জন্য আধা ঘন্টা সময় নিয়ে পুনরায় আমাকে কনফার্ম করলেন, মালিক ৮ ঘন্টা কর্মদবিসের দাবি এখন মেনে নিয়েছে। আমি বল্লাম, তবে শ্রমিকদের একথা আপনারা জানিয়ে দিন। তারা বল্লেন, আমি সেখানে না গেলে শ্রমিকেরা  তাদের কথা বিশ্বাস করবে না। তখন তারা আর দেরি না করে আমাকে বিসিকে আসার জন্য অনুরোধ করলেন এবং জানালেন ৮ ঘন্টা কর্মদিবস সহ ১৮ দফার চুক্তিনামা কম্পিউটার  টাইপ করা হচ্ছে। তারা আমার জন্য গাড়ি পাঠাতে চাইলে আমি বলি দরকার নেই। তখন গার্মেণ্টস শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কমীদের বিষয়টি অবহিত করে আমি রাত প্রায় সাড়ে ১১টায় রিক্সায় বিসিকে রওনা দেই। এমনিতেই ছিল শীতের রাতের কুয়াশা, আবার রমজান মাসের কারণে বিসিকের অধিকাংশ কারখানার বাতি নেভানো থাকায় চারদিক ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্যানটেক্স গার্মেন্টস এর গেটে গিয়ে দেখি আমাদের সংগ্রামী শ্রমিক ভাই বোনেরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যাাচ্ছে।
উল্লেখ্য থাকে যে, নারায়ণগঞ্জ হল ঐতিহ্যগত ভাবে শ্রমিক আন্দোলনে কেন্দ্রস্থল। প্রত্যক্ষ ভাবে আমার এবং আমাদের সংগঠনের পরিচালনায় ও নির্দেশনায় বহু কারখানায় দাবি-দাওয়া আদায় এবং ট্রেড ইউনিয়ন সহ  ন্যায় সংঘত দাবি আদায় হয়েছিল। এ ধরনের একটি আন্দোলনের  অভিজ্ঞতার পটভূমি পূর্ব থেকেই গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনকেও প্রেরণা জুগিয়েছিল।
এদিকে বিসিকের চারদিকে আন্দোলনের উত্তাপ তখন ক্রমশঃবেড়েই চলছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনমূখী এই টগ্বগে অবস্থা প্যানটেক্স গার্মেন্টস মালিক পক্ষ কখনোই কেয়ার করার প্রয়োজন মনে করেনি। উপরন্তু নিজেকে স্বরাষ্ট্র সচিবের আত্মীয় বলে মিথ্যা পরিচয় জাহির করে সরকারিদল ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে, টাকার দাপটে উক্ত মালিক বেপরোয়া মারমুখী হয়ে উঠে। তারা শ্রমিকদের উপরে দমন পীড়ন খুবই বাড়িয়ে দেয়, এমনকি রমজান মাসে শ্রমিকদের নামাজের সময় অযুর পানির কল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়, এতে শ্রমিকেরা আরো উত্তোজিত হয় উঠে। মালিক দাবি না মেনে তালবাহানা করার কারণে শ্রমিকেরা শিপ্মেন্ট আটকে দিয়ে কারখানা ঘেরাও করে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এটাই ছিল তখন তাদের একমাত্র পন্থা, যাতে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের ক্ষমতা ও উৎপাদনে শ্রমিকদের অবদানকে স্বীকার করতে পারে।
শ্রমিকরা রাতের ঘুম হারাম করে তিন দিন / তিন রাত একটানা কারখানা ঘেরাও করে গেটের সামনে মাটিতে বসে আন্দোলন  চালিয়ে আসছিল। আমি সেখানে গিয়ে আমার সাথে কিছুক্ষন আগে টেলিফোনে ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে যে কথা হয়েছে, তা সর্বপ্রথম কারখানার গেটের সামনে আন্দোলনত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে সবকিছু তাদের অবহিত করি।
অতঃপর নেতা পর্যায়ের কয়েকজন গার্মেণ্টস শ্রমিককে সংগে নিয়ে আমি পার্শ্বের ৮ম তলায় যাই এবং চুক্তিনামার কথা জিজ্ঞাস করি। তারা কথা ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং গড়িমসি করতে থাকে।
এরপর ম্যাজিষ্ট্রেট, মালিক ও তাদের কয়েকজন মাস্তান সবাই আমার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে উগ্র ভাষায় কথাবর্তা বলতে থাকে, পিস্তল শো করে আমাকে প্রাণে ফেলার হুমকি দেয়। এনডিসি সৈয়দ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে মালিক ও পুলিশের কর্তারা শ্রমিকদের অবস্থান ধর্মঘটের স্থানে যেয়ে, শ্রমিকদের আন্দোলন বাদ দিয়ে চলে যেতে বলে। শ্রমিকরা বলে, যে মালিক এখন  এক কথা বলে ২ ঘন্টার মধ্যে সে কথা পাল্টিয়ে ফেলে, তাকে বিশ্বাস করা যায় না। শ্রমিকেরা তাদের দাবির ব্যাপারে আরও অনড় হয়ে উঠে। এবার ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশের কর্তারা সরাসারি মালিকের পক্ষ নিয়ে শিপমেন্ট এর মাল খালাশ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ম্যাজিষ্ট্রেট বেলাল হোসেন চোখ লাল করে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলে, আন্দোলন বাদ না দিলে শ্রমিকদের লাশের উপর দিয়ে তারা শিপমেন্ট করাবে। সুতরাং এটা পরিস্কার যে, সেদিন শুরু থেকেই মালিক-প্রশাসন আলোচনা নয়, দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছিল।
একটি দৈনিক পত্রিকার সংবাদে প্রকাশ পায়, আগের দিন রাতে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবে মালিক ও প্রশাসনের মধ্যে একটি গোপন মিটিং হয়েছিল এবং সেখানে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে যে করেই হোক প্রশাসন মালিককে ঐ রাতেই শিপমেন্ট করার আশ্বাস দিয়েছিল। যার কারণে কোন রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া ছাড়াই তিনজন ম্যাজিষ্ট্রেট ও বিরাট সংখ্যক পুলিশ নিয়ে রাতের মধ্য ভাগেই প্যানটেক্স গার্মেন্টস এর সামনে তারা জমায়েত হয়। রাত ৩টার দিকে পুলিশ আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। কারণ জানতে চাইলে তারা আমার উপর আলো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে আরো কয়েক ট্রাক পুলিশ বিসিক এলকায় প্রবেশ করে প্যানটেক্স গার্মেন্টস এর সামনে অবস্থান নেয় এবং কারখানা এলাকার চারপাশে পুলিশ ঘেরাও করে রাখে।
ভোর সোয়া ৫টার দিকে আমাকে গ্রেফতার করে একটি মাইক্রোবাসে করে ফতুল্লা থানায় নিয়ে যায়। সকাল পৌনে ৬টায় বন্দি  অবস্থায় থানার ওয়্যারলেস সেটে বিসিকে রাইফেলের গুলির শব্দ শুনতে পাই। মুনাফার নেশায় পাগল মালিকের স্বার্থে পুলিশ নির্মমভাবে শ্রমিক নিধনে  মত্ত হয়ে উঠে। পুলিশ ঝাপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র আন্দোলনরত অসহায় শ্রমিকদের উপর। রমজান মাসের পরিবর্তিত ডিউটির সময়সূচির কারণে সকাল ৭টার দিকে কারখানামুখী ৫০/৬০ হাজার শ্রমিক রাস্তায় পুলিশের টিয়ার গ্যাস আর হাজার হাজার রাউন্ড গুলির শব্দে আতংকগ্রস্থ হয়ে উঠে। শ্রমিকের আর উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, শ্রমিক হত্যা এবং বিনা কারণে আমাকে থানায় আটক করার সংবাদ বিসিকসহ পাশর্^বর্তী সকল গার্মেন্টস কারখানায় দাবানলের আগুনে মতো ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশি অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে গার্মেন্টস শ্রমিকসহ বসতির আশে পাশের বাসা বাড়ী, বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী হঠাৎ নামা বন্যার মতো রাস্তায় ব্যাপক প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়ে তোলে।
মুহুর্তের মধ্যে প্রতিরোধের আগুন আগ্নেয়গিরির মতো তীব্র গতিতে পুরো শহর প্লাবিত করে তোলে। শহরের চতুর্দিকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অনবরত মিছিরে পর মিছিল চলতেই থাকে। প্রতিরোধের মিছিল যেন শেষ হতে চায় না। একটানা চলতেই থাকে। একটানা চারদিকে নারায়নগঞ্জ প্রশাসনের অত্যাচারের খড় দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে পড়ে যায়। রাজপথ দখল করে দখল করে নেয় বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিকেরা। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিক জনতা প বটি, শাসনগাঁও, কাশিপুর, জামতলা, ফতুল্লা, বিসিকের ৩০-৪০ হাজার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক সকল পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙ্গে বীরদর্পে থানা থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্য ফতুল্লা থানা ঘেরাও করে ফেলে। এ সংবাদ জানতে পেরে পাগলা, শ্যামপুর, কাঠেরপুল, পোস্ট অফিস এলাকা সহ পাশ^বর্তী সকল কল-কারখানার শ্রমিকেরা কারখানা বন্ধ করে দিয়ে বাধ ভাঙ্গা  মতো শুধু ফতুল্লা থানার দিকে ছুটে আসতে থাকে। সাংবাদিক শরফুদ্দিন সবুজ, কামাল, ফটোসাংবাদিক প্রণব, পাপ্পু, শ্যামল, শিপন, জিয়াসহ ফতুল্লা প্রেসক্লাবের সভাপতি ওবায়দুল্লাহ্ তাৎক্ষণিকভাবে লক-আপে এসে থানার বাহিরের পরিস্থিতি আমাকে  অবগত করে। মিনিটে মিনিটে থানার চারদিকে শ্রমিক চাপ ক্রমশ ভয়াবহ আকারে শুধু বেড়েই চলছে। যে কোন সময় বিরাট রক্তারক্তি হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে থানা থেকে সকল পুলিশ যে-যেভাবে পারে দ্রুত পালিয়ে যায়। একজন বৃদ্ধ সেন্ট্রি ছাড়া থানা তখন পুলিশ শূন্য। থানার চতুর্দিকে শ্রমিকদের শ্লোগানের গর্জণ প্রকট আকার ধারন করছে, থানা কেঁপে  উঠছে। এমনিতর মুহুর্তে বাধ ভাংঙ্গা
বনের মতো গর্জণ করে হাজার হাজার শ্রমিক থানার ভিতরে ঢুকে পড়েছে। আমার মনে হয় ঐ মুহূর্তে হাজার হাজার শ্রমিক মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল।
এমতাবস্থায় পুলিশ বেপরোয়াভাবে শর্টগানের গুলি চালাতে শুুরু করে। এবং ৭০/৮০ জন শ্রমিক অমারা সামনে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। তখন জেলার আইনজীবী সমিতি এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এ্যাডভোকেট মাসুদ-উর-রউফ, এডঃ ইসহাক তালুকদারকে রাস্তার একটি দোকান থেকে ফোন করি।  তাহার জানালো থানা পুলিশ, ম্যাজিস্টেডদের কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করে শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ শহর দখল করে ফেলেছে। তখন আইনজীবিরা কোট কাচারী বন্ধ করে রাখে। ১১ দলের নেতৃত্বে হাজার হাজার শ্রমিক এক বিশাল  মিছিল নিয়ে ডিসি কোর্টে ঢুকে ডিসি কোর্ট ঘেরাও করে ফেলে। আমিও দ্রুত মিছিলে যোগ দেই। এরপর দুপুর পর্যন্ত ডিসি কোর্ট ঘেরাও করে রেখে, ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জ থানায় বন্দি সকল গার্মেন্টস শ্রমিক ভাইদের মুক্তির দাবি জানাই এবং আমরা তাদের মুক্তি করে নিয়ে আসি। এদিকে শহর এবং পাশর্^বতী রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা বিক্ষোভ মিছিল যেন শেষ হতে চায় না। প্রতিরোধের ঢেউ ঝড়ের বেগে বেড়েই চলেছে, আশে-পাশের এলাকার অন্যান্য পেশায় শ্রমিক ও মেহনতি মানুষেরাও ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে  এগিয়ে আসতে থাকে। শহরে চলতে থাকে। অঘোষিত হরতাল, বিকাল ৫ টায় কেন্দ্রীয় শ্রমিক নেতা সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি কমরেড আবদুল্লাহ সরকারের সাথে স্থানীয় ১১ দল নেতাদের-তাৎক্ষণিক সভায় শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে হরতাল এবং ৪ নভেম্বর ঈদগাহ মাঠে শহীদ আমজাদ হোসেন কামালের জানাযার কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়।
রাতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং পরেরদিন সংবাদপত্রে এ খবর জানতে পেরে সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। প্রগতিশীল বামপন্থি রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন ঢাকায় বিক্ষোভে ফেটে পরে। ধিক্কার ও নিন্দা জানানো হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। অবশেষে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সরকার প্রশাসন তাদের অ্যাকশন থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। মালিক প্রশাসন শহীদ আমজাদ হোসেন কামালের লাশকে ভয় পেয়ে, জানাযার জন্য লাশ ফেরৎ না দিয়ে প্রশাসন ও গিয়াসউদ্দিন এম.পি বিডিআরের পাহাড়ায় রাতের অন্ধকারে কাশিপুরে তাকে দাফন করে দেয়।
৫ নভেম্বর হরতাল চলাকালিন প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং বাসদ আহŸায়ক কমরেড খালেকুজ্জামান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ছুটে আসেন ২নং রেল গেইট-এর রক্তে ভেজা বিশাল শ্রমিক সমাবেশে। সমাবেশে এক দাবি, শ্রমিক হত্যার বিচার চাই, করতে হবে। এ সময়ে ড. কামাল হোসেন ৭ দিনের মধ্যে বিসিকে শহীদ কামাল হত্যার বিচার ও ঘটনার তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানান। অন্যথায় বিচার বিভাগীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করে প্যানটেক্স গার্মেন্টসে গুলি, শ্রমিক হত্যার কারণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন।
অতঃপর ৬ ডিসেম্বর শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপরে জুলুম-নির্যাতনে দীর্ঘ্য দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ-৩রা নভেম্বর একটি বিস্ফোরণ মাত্র। এই ঘটনাই প্রমাণ করে গার্মেন্টস মালিকেরা কিভাবে শ্রম আইন ও মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে। গার্মেন্টস সেক্টরে মালিকেরা যে নব্য দাস ব্যবস্থা কায়েম করেছে-৩রা নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ শ্রমিক অভ্যুত্থান হলো তার একটি আনুষ্ঠানিক জবাব মাত্র। গার্মেন্টস মালিকেরা রাতা-রাতি পাজেরো গাড়ি আর কোটি টাকার বাড়ী তৈরি করেন অথচ যে শ্রমিকদের হাড়ভাংগা মেহনতে দেশের ৭৬% ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়, সে শ্রমিক থাকে সবচেয়ে অবহেলিত, অধিকারবিহীন। নারায়ণগঞ্জে ৩রা নভেম্বর শ্রমিক অভ্যুত্থান বিপ্লবী সংগ্রামের এক খন্ড ইতিহাস। এ অভ্যুত্থানে দীর্ঘ্য দিন মার খাওয়া শ্রমিকেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে। রাজপথে শ্লোগানের ধ্বনিতে প্রতিবাদের ভাষা নিজেদের অস্তিত্বের শক্তিকে অনুভব করতে শিখেছে। একবার মা ডাক শিখে যে শিশু, সে ডাক আর ভুলে না, তেমনি “দুনিয়ার মজদুর এক হও” শ্লোগান একবার যে শ্রমিক শিখেছে সে কখনো আর ভুলবে না। #
লেখকঃ
এ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল

নার্সারীতে সফলতা পেয়ে নার্সারী নুরুল ইসলাম সাত বার অর্জন করেছেন জেলা প্রশাসনের সম্মাননা পদক

ফেইসবুকে আমরা

এ সম্পর্কিত আরো খবর...