শিরোনাম
তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্প প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীদের নজরে অন্যতম ঝুকিপূর্ণ বাংলাদেশ
বিলকিস ঝর্ণা: গত সোমবার ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা পর ৭ দশমিক ৬ মাত্রার দুটি বড় ধরনের ভয়াবহ ভূমিকম্প পর পর আঘাত হানে সিরিয়ার সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত অসংখ্য মানুষ। জানা যায় ৭০ হাজার। আর যারা চাপা পড়ে আছে তাদের বাঁচার আজাহারিতে তুরস্কের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। মাত্র এক মিনিটের ভূমিকম্পে তুরস্ক আজ মৃত্যুপুরী। প্রাণপণ প্রচেষ্টায় চলছে উদ্ধার কর্ম। বাংলাদেশ থেকেও ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে একটি টিম।
যত সময় যাচ্ছে তত কমছে জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা। সাহায্যের জন্য চিৎকার করছেন ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে আটকে পড়া লোকজন পাঠাচ্ছে ভিডিও, ভয়েস নোট এবং তাদের লাইভ অবস্থান। কিন্তু সাংবাদিকরা কিছুই করতে পারছে না। উদ্ধারকাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তীব্র ঠান্ডা, বৃষ্টি, যোগাযোগে বিপর্যয়সহ নানা সমস্যা। খাদ্যসংকট, বরফ ঠান্ডায় কাবু গৃহহীন লাখো মানুষ। উপদ্রুত এলাকাগুলোর বেঁচে থাকা মানুষেরা চরম দুর্দশায় রয়েছে বিদ্যুতের অভাবেও। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আসা উদ্ধারের আকুতি ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে। সময় ফুরিয়ে আসছে, কমছে আশা, বাড়ছে ক্ষোভ-হতাশা-মৃত্যু। মানবিকতা বিপর্যস্ত এক মর্মান্তিক দৃশ্যে ভরা মাইলের পর মাইল বিধ্বস্ত একটি দেশ। অপ্রতুল সাহায্য সংস্থা আর উদ্ধার ব্যবস্থায় দিশাহারা প্রত্যক্ষদর্শীরা। তুরস্কের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা যতটুকু যাচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়।
ইমার্জেন্সি রেসপন্স গ্রুপ বলছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের বাঁচাতে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এই শীত মৌসুমে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেলে উদ্ধার অভিযান আরো ব্যাহত হবে। বৃষ্টির কারণেও ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার তৎপরতা। বিদ্যুৎ না থাকায় রাতের অন্ধকারে বন্ধ উদ্ধারকর্ম। সিরিয়ায় উদ্ধার অভিযানে ইতোমধ্যেই সমস্যা বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তুরস্ক থেকে জাতিসংঘের জরুরি সাহায্য পাঠানোর পথ বন্ধ। আবার উদ্ধার অভিযানে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোও পুরনো হওয়ায় সহায়তার জন্য নেই পর্যাপ্ত এক্সকেভেটর। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বলছে, স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্প।
ইতিপূর্বেও বিভিন্ন ভূতত্ত্ব গবেষকরা বলেছেন, তুরস্ক পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। এতটা জানার পরও কেন তুরস্ক মৃত্যুপুরী। দুর্ভাগ্যবশত দক্ষিণ তুরস্ক এবং বিশেষ করে সিরিয়ায় অবকাঠামোগুলো মোটেই ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়। তাই জীবন বাঁচানোটা কেবল উদ্ধার তৎপরতার ওপরই নির্ভরশীল।
বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের কারণ এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, পৃথিবীর ভূ-স্তরের বাইরের অংশটি (ভূ-পৃষ্ঠ) অনেকগুলো টুকরো দিয়ে গঠিত, এগুলোকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট। পৃথিবী সৃষ্টির পর প্রথমদিকে এই প্লেটগুলো একসঙ্গে ছিল। সঞ্চরণশীল এই প্লেটগুলোর সীমানা ‘সিস্টেম অব ফল্টস’ বা চ্যুতি হিসেবে পরিচিত। ফল্ট হচ্ছে দুই প্রস্থ প্লেটের মধ্যখানের ফাটল বা চ্যুতি। টেকটোনিক প্লেটের এই চ্যুতিগুলোতে চাপ তৈরি হলে সেগুলো হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে ভূমিকম্পের কারণ হয়। তুরস্কের ভূভাগের মধ্য দিয়ে এমনই দুটি ফল্ট লাইন চলে গেছে যার নাম ‘নর্থ আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন’ ও ‘ইস্ট আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন’। এই দুই ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত হওয়ায় তুরস্ক বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। এমন ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত কোনো দেশে ভবন নির্মাণে নির্মাণ বিধিনিষেধে ছাড় দেওয়া অবশ্যই বড় ধরনের অপরাধ। তারপরও উন্নয়নের নামে চলেছে ভবন তৈরি। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ভবন নির্মাণশৈলী এমন হতে হবে যেন তা ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করতে যথেষ্ট হয়।
তুরস্কের ভয়ানক দুরবস্থায় আলোচনায় আসছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর। তুরস্কের তুলনায় ঢাকা অনেক ঘনবসতির নগর। এখানে দুর্যোগ মোকাবিলার নেই কোনো সুচিন্তিত পরিকল্পনা। অপরিকল্পিত বাসভবনে ঠাসা আমাদের রাজধানী। নেই কোনো নির্মাণ বিধিমালার কার্যকারিতা। মহানগর বা মেগাসিটির ক্ষেত্রে জনঘনত্বের মানদণ্ড ধরা হয় একরপ্রতি সর্বোচ্চ ১২০ জন। অথচ ঢাকার ৬৩ শতাংশ এলাকায় প্রতি একরে ৩০০ জনের বেশি মানুষ বাস করে। একরপ্রতি জনঘনত্ব ৪০০ জনের বেশি ঢাকার ৪০ শতাংশ এলাকায়। যার চাপ সামলাতে প্রায় সব এলাকায় যথেচ্ছভাবে জঙ্গল কাটা হয়েছে, জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি হয়েছে অজস্র বহুতল আবাসন ও সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক ভবন। বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে এবং পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর একটি মানচিত্র তৈরি করে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রস্তুতি নেয়ার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম নামে
একটি কর্মসূচি চালু করেছিল। সেই প্রকল্পের আওতায় অতীতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের তথ্য এবং গবেষণার ভিত্তিতে বিশ্বকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের যেসব এলাকা বিজ্ঞানীদের বিশেষ নজরে রয়েছে। বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম ।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কাজেই বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ দেশ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেবল কবে কখন সেইটা জানা আমাদের আয়ত্তের বাইরে। এসব ফল্টে ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা কতটা তা বলা বাহুল্য। প্রযুক্তির এই অত্যাধুনিক সময়েও এমন কোনও প্রযুক্তি এখনও তৈরি হয়নি যা বিধ্বংসী এই ভয়াবহ ভূমিকম্পের আগাম বার্তা পৌঁছে দিবে মানুষের কাছে। যে পূর্বাভাসের খবর পেয়ে মানুষ পৌঁছে যাবে নিরাপদ জায়গায়। স্বস্তির জায়গায়। পূর্বাভাস দিতে না পারলেও ভূতাত্তি্বকগণ কোনো বিশেষ দেশ বা স্থান কতটা ভূমিকম্পপ্রবণ, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেটা অনুমান করতে পারেন। সেই তথ্যের ওপর নির্ভর করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভূমিকম্প সহনীয় বাসভবন নির্মাণের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় উন্নয়ন ঘটালেও সেই শিক্ষা জাপানের কাছ থেকে নেয়া উচিত। পূর্বের বড় বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে জাপানে। কিন্তু সেখানে লাখ লাখ মানুষ জনবহুল এলাকাগুলোর সুউচ্চ ভবনগুলোতে বসবাস করছে। উন্নত প্রযুক্তি, ভূমিকম্প প্রতিরোধী এবং পরিকল্পিত নগরায়নে জাপান প্রকৃতিকে জয় করেছে। মুছে ফেলেছে পুরনো তকমা। জাপানে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি আর আগের মতো নেই। ভবন নির্মাণ বিধিমালা কি করে দুর্যোগের নিরাপত্তা দিতে পারে জাপান বিশ্ববাসীর জন্য সেই উদাহরণ। আমাদেরও সতর্কতা প্রয়োজন। এখানে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প এলে উৎসস্থলের ১০০ কিলোমিটার বৃত্তে তুমুল ক্ষয়ক্ষতি হবে। এর জন্য দায়ী থাকবে পরিকল্পনাবিহীন নগরায়ণ। প্রকৃতির দিকে নজর না দিয়ে যথেচ্ছাভাবে বহুতল নির্মাণ আমাদের ঠেলে দিয়েছে সমাধানহীন পরিণতির দিকে। যেকোনো সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা অমূলক নয়। কাজেই এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত সেটা বিবেচনায় আনা খুবই জরুরি।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট।