চুষে টসটসে মশা মারছে , কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছে । আজ হয়তো ঝর্ণা খেয়াল করেনি , তাই ঠাণ্ডায় কুকড়ে আছি । ঠাণ্ডার প্রকোপ ও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার কারণেই এই শেষ রাতে এসে ঘুমটা ভেঙ্গে যায় । হাতমুখ ধুয়ে একটু ফ্রেস হয়ে ফ্যানটা বন্ধ করে বিছানায় চোখবুজে চুপচাপ ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি । রাজ্যের কতশত ভাবনা মনের ভেতর উঁকি মারতে থাকে । ভাবতে থাকি , কিছু কি লিখতে বসবো , না আবার ঘুমিয়ে পড়বো । হঠাৎ ডান কানের ভেতরটা কেমন পিলপিল করতে থাকে , চুলকাতে থাকে । মনে হচ্ছে কানের ভেতর কিছু একটা নড়াচড়া করছে । কান চুলকানো একটা বাজে অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে । তাই ম্যাচের কাঠি , মাথার ছোট ক্লিপ হাতের কাছেই রাখি , যেন প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারি । কানের ভেতর নড়াচড়া , চুলকানি দ্রুত বাড়তে থাকে । বেশী চুলকালে এমনটা মনে হয় যে কানের ভেতর কিছু একটা নড়ছে । তবে কাঠি দিয়ে একটু চুলকালে বা ক্লিপ দিয়ে কানের ময়লা পরিষ্কার করলেই সব ঠিক হয়ে যায় । একটা শক্ত ম্যাচের কাঠি দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কানের ভেতরটা চুলকানোর পরও চুলকানি বা ভেতরের নড়াচড়া কিছুই কমছে না । আমি বেশ চিন্তায় পড়ে যাই , সত্যি সত্যি কানের ভেতর কিছু একটা নড়ছে কী ! না এটা আমার মনের ভুল । চোখবুজে এসব ভাবতে লাগলাম । খুব অসস্তি হতে লাগলো ।
হঠাৎ মনে হলো একটা কিছু কানের ভেতর থেকে বাইরে বেড়িয়ে ঠেলে বেড়িয়ে আসার জন্যে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে এবং আমার কানের পরিধি ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাচ্ছে । আমি ভীষণ ভয় পেতে লাগলাম । আমার শরীর শিড়শিড় করে ওঠে । কেমন এক স্নায়বিক বৈকল্যে আমি প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ি । আমি ভয়ে ভয়ে ডান পাশের কানের উপর হাত রাখলাম । একটা প্রাণীর অস্তিত্ব আমি টের পাই । আমার হাতের স্পর্শে প্রাণীটার নড়াচড়া বুঝতে পারি । আমি ভয়ে শিহরে উঠে ঝটকা মেরে হাত সরাতে চাই , কিন্তু হাত সরাতে পারিনা । হাতটা যেন কানের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে । ভয়ে আমার সমস্ত শরীর থরথর কাঁপতে থাকে । আমার ইন্দ্ৰীয় অবশ হয়ে আসে । আমি যেন দেখতে পাচ্ছি , একটা চ্যালা জাতীয় প্রাণী কানের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে আমার হাতের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেড়িয়ে আসছে । চ্যালার মাথার সামনে দুটি বড় শুঁড় , এর নড়াচড়া , তার অনেকগুলো পায়ের অস্তিত্ব আমি টের পেতে থাকি । মুহূর্তের মধ্যেই আমার শরীরের ভেতর এক অবাক করা অভিনব রূপান্তর ঘটতে থাকে । আমার হাত কান , মুখ , মাথা , শরীর , শরীরের বিভিন্ন অংশ এক মস্ত বড় চ্যালায় রূপান্তরিত হতে থাকে । একসময় আমার দেহ পুরোপুরি রূপান্তরিত হয়ে এক ধূসর কালো রঙের চ্যালায় পরিনত হয় । আমি বিছানায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকি ।
আমার আজ বিকালের ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় । আমি ওয়াস রুমে বেসিনের কলটা ছেড়ে হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে টাওয়ালটা নিতে মাত্র হাত বাড়িয়েছি , অমনি ওয়াস রুমের মেঝেতে চোখ পড়ে আমি আৎকে ওঠি । একটা মস্ত বড় ধূসর কালো রঙের চ্যালা মেঝের এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে । চ্যালা কোনো বিপদজনক প্রাণী না । তবুও এটা দেখামাত্র আমার মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়ে । আমি মুহূর্তে পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে পিটিয়ে ওটাকে আধমরা করে ফেলি । তারপর পা দিয়ে শরীরের সর্বোশক্তি প্রয়োগ করে ওর শরীর , মাথা জোড়ে জোড়ে পিষতে থাকি । আমার পায়ের ঘষায় চ্যালাটা কোমর থেকে দুটুকরো হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । টুকরো দুটো সমানতালে ছটফট করতে থাকে । আমি এক বন্য আনন্দে ওর মাথাটা পায়ের তলায় পিষতে থাকি । হঠাৎ আমার মনে হতে থাকে , আমার কোমরের উপর বুটজোেতা পরিহিত দুটি শক্তপোক্ত পা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । একটা বড় পুলিশ ভ্যানে বোঝাই অসংখ্য মৃতপ্রায় ছাত্রদের নির্জীব ক্ষতবিক্ষত দেহ । আমি সবগুলো দেহের নিচে উপুড় হয়ে পড়ে আছি । অনেকগুলো সশস্ত্র পুলিশ দেহগুলির উপর স্বদর্পে দাঁড়িয়ে আছে । আমার কোমরের উপর একজন দুপায়ে দাঁড়িয়ে আছে । আমি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছি । পুলিশের বুটের তলায় পিষ্ট হয়ে আমার কোমর থেকে শরীর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যায় । একজন আমার মাথা তার বুটের তলায় পিষতে থাকে । ভ্যানির পুলিশগুলো বুটের তলায় আমাদের
দেহগুলো পিষতে পিষতে এক বন্য আনন্দে , উল্লাসে যেতে ওঠে । এরশাদ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধ ১৯৮৩’র ছাত্র আন্দোলনের রক্তাক্ত গৌরবময় ইতিহাস আমার মস্তিষ্ক আলোড়িত হতে থাকে । আলোড়িত হতে থাকে ছাত্রদের উপর স্বৈরাচারের পাশবিক নির্যাতনের এক কালো অধ্যায় । আমি দেখতে পাই , এই হীম শীতল ভোরে শত পা বিশিষ্ট ধূসর কালো রঙের একটা মস্ত বড় চ্যালার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে আমার বিছানার উপর পড়ে আছে ।
লেখক —- ম.মানিক
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কথা সাহিত্যিক।