নারায়ণগঞ্জ  বৃহস্পতিবার | ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ | ২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ হেমন্তকাল | ১১ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

শিরোনাম
  |   পূর্বাচল লেকের পাড়ে উদ্ধার হওয়া পলিথিনে মোড়ানো খন্ড বিখন্ড মরদেটি কার ?    |   জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে র‍্যালী গণসমাবেশ    |   সোনারগাঁ বিএনপির উপজেলা ও পৌর কার্যালয় উদ্বোধন    |   সকল রুটে বাস ভাড়া কামানো দাবিতে ৪০২ জন আইনজীবীর স্মারকলিপি প্রদান   |   অটো চাপায় শিশু শিক্ষার্থী নয়ন তারা নিহত   |   ১২ দিনেও সন্ধান মেলেনি মিছিল থেকে হারিয়ে যাওয়া বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ইলিয়াস    |   জাতীয় বিল্পব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বন্দর থানা বিএনপি’র বর্ণাঢ্য র‍্যালী   |   দৈনিক খবরের পাতার সম্পাদকের পিতা ভাষা সৈনিক আবুবকর সিদ্দিকীর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী   |   শ্রমিক অসন্তোষে বিসিক শিল্প নগরীতে গার্মেন্টস ভাংচুর, সড়ক অবরোধ   |   ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম গ্রেপ্তার   |   ঐতিহাসিক বেতিয়ারা দিবস পালনে শহীদদের স্মরন করলো সমমনা    |   ফুলপাখি পাঠশালার ৪ দিনব্যাপী চিত্রকর্ম প্রদর্শনী শুরু    |   নারায়ণগঞ্জে মোহনা টিভির ১৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন   |   সোনারগাঁয়ে ব্যবসায়ীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তারের অভিযোগ   |   নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে হামলার ঘটনায় অধ্যাপক মামুন মাহমুদের নিন্দা   |   আড়াইহাজারে ভাঙচুরের মামলার দুই আসামি গ্রেফতার    |   মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ার সন্ত্রাসী হামলায় ৩ সহদোরসহ ৫ জন আহত   |   নিরীহ যুবককে আটক করে হত্যা মামলায় চালান   |   বদিউজ্জামান হত্যা মামলায় জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল কাদির গ্রেপ্তার   |   জেএসডি’র ৫২তম বার্ষিকী উপলক্ষে নগরীতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
 প্রচ্ছদ   কলাম   ত্বকীঃ আরেক ফাল্গুনের পথে – রফিউর রাব্বি 
ত্বকীঃ আরেক ফাল্গুনের পথে – রফিউর রাব্বি 
  কলাম || নারায়ণগঞ্জেরখবর.কম
প্রকাশিত: শনিবার, ৪ মার্চ, ২০২৩
রফিউর রাব্বিঃ ৬ মার্চ ত্বকী নিখোঁজ হলে আমাদের অন্তরে কারবালার আলোড়ণ শুরু হয়। পরদিন ওর মা ওর সেল্ফ থেকে একটি খেঁরো খাতা নিয়ে আসেন। তাতে গণিত ও পদার্থ বিদ্যার বিভিন্ন সূত্র ও তত্তে¡র পাশাপাশি রয়েছে কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা কবিতা, ভাবনার নিবন্ধিত কিছু কথা ও কাব্যময় বিক্ষিপ্ত ছত্রের সমাহার। একটি কবিতায় এসে চমকে উঠলাম।
আরও একবার আমি মানুষ হয়ে মরব,
উত্থিত হতে নিষ্কলঙ্ক ফেরেশতাদের পাশে।
তবে তা থেকেও উন্নীত হতে হবে আমাকে, কারণ
ঈশ্বর ছাড়া সকলেই যে ধ্বংস হবে।
যে দিন আমার স্বর্গ পবিত্র আত্মার বলি দিব,
আমি হব তাই,
যা ছিল না কখনও কারো কল্পনা চিন্তায়।
আমার যেন বিলুপ্তি ঘটে, কারণ
অনস্তিত্ব ঈন্দ্রিয়ে সুর তুলে
আমি তাঁর কাছে ফিরবে
এই ঝড়ের মধ্যেও চোখের সামনে ভেসে উঠল কাহ্লিল জিবরানের মুখ। সেদিনই ওর এ লেভেল পরীক্ষার প্রথম বর্ষের ফল প্রকাশিত হল। পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে বিশ্বের সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছে। ও লেভেল পরীক্ষায়ও পদার্থ বিদ্যায় দেশের সর্বোচ্চ নাম্বার ছিল। কিন্তু ভাল ফলাফলে কোন আগ্রহ ছিল না ওর। ওর চোখ ছিল অন্যখানে। জগৎ, মহাকাশ ও এর সৃষ্টি নিয়ে ছিল অপার জিজ্ঞাসা। সবকিছুর গভীরে যেত চাইত। সাধারণ ভাল ওর কাছে ভাল ঠেকত না। চোখ ছিল হিমালয়ের চূড়ায়। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন ছিল চোখে।
ও যখন ক্লাশ সিক্স থেকে সেভেন-এ উঠেছে বাংলায় নাম্বারটি ছিল ৬৭ কি ৬৮। আমি বললাল, দ্যাখো বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, তুমি আর যাই শিখ না কেন নিজের ভাষাটা ভালো করে শিখতে হবে। জানতে হবে। একে অবহেলা করলে চলবে না। সেদিন ও কিছুই বললো না। দু’দিন পর বললো; দেখো বাবা, আগামী বছরই বাংলায় আমি ভাল করবো। পরের বছর বাংলায় ওর নাম্বার ছিল সম্ভবত ৮৩ কি ৮৪। ও নিজেকে বুঝতে পারত। নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ওর মধ্যে ছিল।
আক্ষরিক অর্থেই নিভৃতচারী বলতে যা বোঝায় ত্বকী ছিল তাই। মগ্ন চৈতন্যে অন্তর্মূখী অথচ জগৎ ও চারপাশ সম্পর্কে উদাসীন নয়, কৌতুহলী এক কিশোর। আবৃত্তি ভাল করতো। একবার শুনলেই কবিতার মূল সুরটি ধরতে পারতো। দীর্ঘ কবিতা মুখস্থ করে ফেলতো। ওর কণ্ঠের আবৃত্তি বাতাসে কান পাতলে এখনো শুনতে পাই।
মেঘের মধ্যে মাগো যারা থাকে
তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে।
ত্বকী এই আহবান প্রকৃতই শুনতে পেয়েছিল কিনা জানিনা।
বন্ধু-বান্ধব হৈ-হুলোর খুব একটা পছন্দ করতো না। বন্ধু তেমন একটা ছিলও না। বন্ধু বলতে হয়তো আমিই ছিলাম। কারণ ওর যা বলার, যতটুকু বলার প্রয়োজন বোধ করতো আমার সাথেই করতো। কারো বিরুদ্ধে কখনো অভিযোগ ছিল না। বন্ধু, পরিজন, শিক্ষক কারো সম্পর্কে কখনো কোনও অভিযোগ করেনি। কেউ দুঃখ পাবে এমন আচরণ ছিল ওর নীতি ও রীতি বিরুদ্ধ। দূরের বা অপছন্দের কেউ হলেও না। ছিল স্বল্প ও মৃদু ভাসি। প্রকৌশলী হবার ইচ্ছে ছিল। বলেছিলাম, এ লেভেল এর শেষে দেশের বাইরে চলে যাও। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এসো। ও দেশের বাইরে যেতে চাইতো না। মাকে বলতো, দেশে থেকে কি লেখাপড়া হবেনা? দেশের পড়াশোনা কি এতই খারাপ যে, বাইরে যেতেই হবে? আমি শুনে বললাম, বাইরে যাওয়াটা দোষের কিছু না। আমাদের সামনের যে মানুষগুলো রয়েছেন তারা সবাইতো বাইরে গিয়েছেন, বিশ্ব ঘুরেছেন। বাইরে না গেলে ভিতরটাকে ঠিক জানা যায় না। ভিতরটা ভালো করে জানার জন্য, বোঝার জন্য হলেও বাহিরটাকে জানার প্রয়োজন পড়ে। আমার সাথে কিছুই বললো না। পরে মাকে বললো, তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না, থাকতে পারবো না। আজ বড় জানতে ইচ্ছে করে আমাদের চিরতরে ছেড়ে ওখানে কী করে আছো?
ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারদের বোর্ড প্রধান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ত্বকী’কে মাথার তিনদিক থেকে আঘাত করা হয়েছে। এ আঘাতই তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হত্যাকারীরা মৃত্যুটা ত্বরান্বিত করার জন্য গলা চেপে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করেছে। একটি চোখ উপরে এনে দেহের মধ্যভাগের একটি অঙ্গ থেতলে দিয়েছে।’ আদালতে শিকারোক্তি মূলক জবানবন্দীতে হত্যাকারী এক ঘাতক বলেছে, গজারীর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করার পর ত্বকীর বুকের উপর উঠে গলাটিপে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।  ঘাতকরা যখন ওকে মাথায় আঘাত করেছে আমি জানিনা জোরে কথা বলতে না চাওয়া ত্বকী তখন চিৎকার করেছে কিনা! কী বলেছে ওদের! কাউকেই কখনো কষ্ট দিতে না চাওয়া ছেলেটির কী আচরণ ছিল তখন! ঘাতকের শক্ত বাহু যখন ওর কণ্ঠ সজোরে সারাশির মতো আঁকড়ে ধরেছিলো তখন মানুষ সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, জগৎ সম্পর্কে মানবতা-মনুষত্য এসব সম্পর্কে ওর নতুন কোন ধারনা তৈরী হয়েছিল কিনা, বোধ তৈরী হয়েছিল কিনা। এতদিন যে ধারনা ওর মধ্যে তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল তার কোন বদল হয়েছিল কিনা আজ তা জানতে ইচ্ছে করে।
‘একজন শহীদের ময়নাতদন্ত’ শিরোনামে ইংরেজী একটি কবিতায় ত্বকী লিখেছে।
                                                                  ওরা ছুরি ও
ধারালো অস্ত্রদিয়ে
দ্বিখন্ডিত করে কন্ঠনালী
ওরা উল্লাশে দেখে
কিভাবে শরীর থেকে
বৃষ্টির মতো রক্ত গড়ায়।
ধারালো অস্ত্র দিয়ে
শরীরের চামড়া ছিলে নেয়
এবং দেখে ভেতরের মাংসপেশী ও হাড়-গোড়
ওরা টুকরো টুকরো করে হাড়-গোড়
খন্ড বিখন্ড করে ফেলে
বিভৎস উল্লাসে
এই সব হাড়-গোড় শরীরে জড়িয়ে
জানান দেয় নিজেদের সাহসিকতা
স্মারক চিহ্ন করে
ঝুলিয়ে নেয় গলায়।
ওরা সেই সব মৃত মানুষের মাংস খায়
বর্বর অন্ধকার যুগে যেমনি মানুষখেকোরা
ভক্ষণ করেছে তাদের স্বজাতিকে।
নিখোঁজ হওয়ার ছ’দিন আগে আমি আর ত্বকী শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পারের বন্দর থেকে ফিরছিলাম। নদী পার হতে হতে নৌকায় বসে ত্বকী প্রশ্ন করলো, মারেফাতের রং কী? বললাম, কালো। শরীয়তের? সাদা। ওকে দু’টি গল্প বললাম। এক সুফী সাধকের দরবারে কালো কোর্তা পড়ে এক ফকীর ঢুকছেন। সুফী ব্যক্তিটি তাঁর অনুসারীকে বললেন, ওকে ঘাড় ধরে বের করে দাও। ফকীরকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হলো। ফকীর আবার ঢুকলেন। সুফী ব্যক্তিটি আবার বের করে দিতে বললেন। এমনি তিনবার তাঁকে বের করে দেওয়ার পর যখন আবার ফকীর ঢুকেছেন তখন সুফী ব্যক্তিটি ফকীরকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমিই কালো পড়ার উপযুক্ত। ক্রোধ ও ষড়রিপু যার নিয়ন্ত্রণে এসেছে সেই এর যথার্থ অধিকারী।’ বললাম, মনসুর হালাজকে যখন কারাগারে আবদ্ধ করা হলো তখন তাঁর বিচারের ভার রাজ্যের শাসনকর্তা সে সময়ে সে তল­াটের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী জোনায়েদ বোগদাদী’র উপর ন্যস্ত করলেন। জোনায়েদ বোগদাদী সাধারণত সাদা পড়তেন না। কিন্তু বিচারের রায় ঘোষণার দিন তিনি সাদা পোশাক পড়ে বেরুলেন। মনসুর হাল্লাজের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার অবস্থা আমি জানি। আল্লাহ্ আরও ভালো জানেন; কিন্তু শরীয়তের বিধানই আমাদের বিচারের মানদন্ড। এ বিধানে এর রায় মৃত্যুদন্ড বৈ কিছুই নেই।’ ত্বকীর পছন্দের রং ছিলো কালো। কালো জামা প্রিয় ছিল। ৬ মার্চ বিকেলে বাসা থেকে যখন বের হবে পরনে কালো জিন্স আর গায়ে সাদা টি-শার্ট। আমি বললাল জামাটা বদলে নাও। ও কালো একটা জামা পড়ে নিল। জীবনের সমস্ত ধকল ঐ জামাটির উপর দিয়ে গেল। ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যার পাড়ে যখন কাদা-বালিতে পড়ে ছিল চেনার জো ছিলনা। এ জামাটিই ত্বকীকে চিনতে সাহায্য করেছে।
ছোট থেকেই পাঠ্য তালিকার বাইরের বইয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল। ত্বকী যখন ক্লাশ এইটে তখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াব নামা, চিলে কোঠার সেপাই, টলষ্টয়ের ওয়্যার এন্ড পীস পুরোটা পড়েছিল। ও লেভেল পরীক্ষার শেষে এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজম, রিপ্রেজেন্টেশনস্ অব দ্যা ইন্টেলেকচুয়াল পড়েছে। পরে দেখেছি জ্যাক দারিদা মনযোগ দিয়ে পড়তে। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী তুমি বুঝতে পারছ? উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল। নিখোঁজ হবার মাস খানেক আগে থেকে দেখেছি ফ্রেডরিক নিট্শে’র জড়থুস্ত্র বললেন, গভীর মনযোগ দিয়ে পড়ছে, সাথে টলষ্টয়ের ছোট গল্প। আইনস্টাইন ওর প্রিয় ছিলো। প্লেটো’র রিপাবলিক ও পড়েছে। লালন এর প্রতি আকর্ষণ ছিলো। আগ্রহ ছিলো সুফীবাদে। সুধীজন পাঠাগার থেকে আনা ওর বইয়ের তালিকায় মূলত ছিলো গণিত ও পদার্থ বিদ্যা।
১০ বছর বয়সে ত্বকী কোরআন শরীফ পাঠ শেষ করেছিল। রমজান মাসে পুরো ত্রিশটি রোজা রাখতো। আমি মাঝে মধ্যে নিষেধ করতাম, কিন্তু জোড় করতাম না। আমরা কখনোই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে কিছু বলিনি। বলার প্রয়োজন পড়েনি। ওর পড়াশোনার নিজস্ব একটা নিয়ম ও নিজেই তৈরী করে নিয়েছিল। স্কুল থেকে বিকেলে এসে ঘুম। রাতে উঠে খাবার সেরে পড়া শুরু করে টানা ভোর তিনটা-চারটা। কিন্তু সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুজে থাকাটা ওর স্বভাব ছিলোনা। কিন্তু যতক্ষনই পড়তো মনোযোগ দিয়ে পড়তো। পড়াটাকে ও উপভোগ করতো। স্কুলে বা বাইরে কখনো কোচিং করেনি। বিভিন্ন সময়ে কোচিং করার প্রয়োজন আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছে, প্রয়োজন নেই। ত্বকীর এ লেভেল পরীক্ষার আগে ওর স্কুলের এক শিক্ষক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন তাঁর কোচিং না নিলে ত্বকী পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। বিষয়টা ত্বকী বাসায় বলেনি। ফল প্রকাশের পর সে শিক্ষক কেঁদে বলেছিলেন, ‘চ্যালেঞ্জে ত্বকী আমাকে হারিয়ে দিয়ে গেল।’
এ লেভেল পরীক্ষার পরে ও একদিন বলল, আচ্ছা পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের দরকারটা কী? আমাদের সামনের বড় বড় মানুষদের কারোরইতো পরীক্ষায় ফল ভালো দেখছি না। বড় হতেতো ভালো ফলাফলের প্রয়োজন পড়েনা। বললাম, বড় হতে বা মানুষ হতে হলে ভালো ফলাফলের প্রয়োজন পড়ে না ঠিকই তবে, যে সময়টা তুমি এই পড়াশোনার জন্য ব্যয় করছো তার সঠিক ব্যবহারটা নিশ্চিত হলো। কখনো বাসায় ফিরতে দেরি হলে ফোনে জানিয়ে দিতাম খেয়ে নিতে। কিন্তু গিয়ে দেখতাম সবাই খেয়ে নিলেও ত্বকী না খেয়েই বসে আছে। খাবার দাবারে খুব একটা আগ্রহ ছিলনা। খুব কম খেতো। ওকে জোর করে খাবার দিতে হতো। আমি ছাড়া অন্য কেউ দিলে আবার নিতে চাইতো না। মুখফুটে কখনোই কিছু চাওয়া ওর স্বভাবে ছিল না। দাবা খেলতে ভালোবাসতো। ক্রিকেট খেলাটা পছন্দ করতো।
মৃত্যুর পর খেঁড়ো খাতায় দেখলাম, এক জায়গায় লিখেছে- ‘হৃদয়ে আজ নব বসন্তের গান / পাখির ডাকের সাথে ধ্বনিত হচ্ছে শাহবাগের শ্লোগান।’ শাহবাগের জাগরণ মে র প্রতি ওর প্রবল আগ্রহ ছিলো। নিজের ইচ্ছের কথা কখনোই সরাসরি বলতো না। ঘুরিয়ে বলাতো। একদিন বললো, ওর সহপাঠিরা আগামীদিন সবাই শাহবাগে যাবে বলে ঠিক করেছে; ত্বকী তাদের সাথে যাবে কিনা তারা জানতে চেয়েছে। সেদিনটিতে ছিলো শাহবাগে জাগরণ মে র এক মহাসমাবেশ। পাশাপাশি বিএনপি এবং জামায়াতেরও একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি। চলমান সহিংস ও সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে অনিবার্য আশংকা থেকে বলেছিলাম, আগামীকাল যেওনা; দু’চারদিন পর আমিই তোমাকে শাহবাগে নিয়ে যাবো। আমাদের নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠা জাগরণ মে র ব্যস্ততায় ত্বকীকে নিয়ে আর শাহবাগে যাওয়া হয়ে উঠেনি। পরে দেখলাম ত্বকী তার খাতায় লিখেছে, ‘লুকোচুরি খেলবো বলে চলে এলাম তোমার আগে / সংগ্রাম চলছে শাহবাগে।’ শাহবাগ নিয়ে ইংরেজীতে ‘শাহবাগ সংগ্রাম’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছে। রাজীব হায়দারকে নিয়ে  লিখেছে।
                                                                               ফুলের মতো দৃশ্যমান
                                                                               রক্তমাখা রাজীবের চোখ
সবুজ পাতার সাথে
দৃশ্য জুড়ায়
লাল-সবুজের পতাকা-
যেন বলে উঠে
এইতো স্বদেশ
লাল-সবুজের বাস যেখানে
প্রকৃতি ও সংগ্রামে-
এই পৃষ্ঠায়ই দু’টি লাইন লিখেছে ‘কোকিলের পাশাপাশি উড়ে চলে/শোকের কালো পতাকা।’ লাইন দু’টি আবার কেটে দিয়েছে। শোকের পতাকা হয়তো ত্বকী ওড়াতে চায়নি। অন্তহীন শোকের পূর্বাভাস হয়তো তার আগেই জানা ছিল। একটি কবিতায় লিখেছে।
সমগ্র মানব জাতি আজ
এক কাতারে দাঁড়াবে
——————
জলাঞ্জলী দিয়ে হিসেব কষা
ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান
বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।
এটা বিশ্বাসের কথা; স্বপ্নের কথা। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই সমগ্র মানব জাতিকে এক কাতারে দাঁড় করাবার সেইযে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে তাতে আমাদের সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সবই এরই দোহাই দিয়ে আজ অন্ধ গলিতে ঢুকে পড়ছে। আজকের কর্তব্যটি তারি বিরুদ্ধে। সে কাজ সম্পর্কে কতটা ধারনা ছিল ত্বকী’র জানিনা। তবে সে তার জন্য নিজেকে যে ধীরে ধীরে তৈরী করে চলেছিল সেইটি বোঝা যায়। কিন্তু ত্বকী অবশেষে অঙ্কুরেই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোর সাথে গিয়ে মিশে গেলো, মিশে গেলো ঝড়া পাতাদের দলে।
‘ফিরে এসো বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইংরেজীতে একটি কবিতায় লিখেছে।
                                                                              যাঁরা যুদ্ধের ডাক দিয়ে ছিল
                                                                              যাঁরা অপেক্ষায় আছে আজো একটি বিচারেরÑ
একটি বিচার
যা শেষ করার জন্য
তাঁরা
যুদ্ধের সেই সব নায়কেরা
ডাক দিয়ে যায়।
জাতির জন্য, জেগে ওঠার জন্য
ঐজাতির জন্য; যারা ধ্বংসের মধ্যেও
নতুন জীবনের ডাক দিয়ে যায়;
তুমি কি শুনতে পাও
সেই সব শহীদদের কন্ঠস্বর?
কবিতা লেখার কথা ত্বকী বলেনি কখনো। এগুলো হয়তো নিখোঁজ হবার আগের দু’তিন মাসের মধ্যে হবে। ইংরেজিতে লেখা কয়েকটা গল্প, নিবন্ধ ইতোপূর্বে সে দেখিয়েছে। খাতার এক জায়গায় লিখেছে, ‘ধ্যান, পড়াশোনা, গান, লেখালেখি, সমাজ’। কোথাও লিখেছে, ‘প্রবন্ধ লিখব, গল্প লিখব, ভালো লিখব’। লেখালেখির ইচ্ছে ওর মধ্যে ছিল। একদিন জিজ্ঞেস করলো, ভালো লিখতে হলে কি করতে হবে? বললাম, পড়তে হবে, চারপাশটা দেখতে হবে, তারপর লিখতে হবে। তারপর আবার পড়তে হবে, একে চারপাশের সাথে মিলিয়ে নিতে হবে, পরে আবার লিখতে হবে; এভাবে করে করেই একসময় লেখা হয়ে যাবে। শৈশব থেকেই ত্বকী ছবি আঁকতে ভালোবাসতো। প্রথম আলোর গোল্লাছুটে প্রায়ই আঁকা ছবি ছাপা হতো। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ শিরোনামে ও একটি ছবি এঁকেছিল। ব্যানার ফেস্টুন হাতে শিশুদের মিছিল। শান্তির মিছিল। যুদ্ধের বিপক্ষে ত্বকী ছিল শান্তিপ্রিয়।
গান শিখতো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। মাঝেমধ্যে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতো। লালন ও হাছন রাজার গান ওর প্রিয় ছিলো। সময় পেলেই লালনের গান শুনতো। ওর খেঁড়ো খাতায় দেখলাম লালনকে নিয়ে ‘ফকির লালন শাঁই’ শিরোনামে ইংরেজিতে লেখা ছোট্ট একটি নিবন্ধ লিখেছে। সেখানে লিখেছে, ‘লালনের দর্শন গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবদের সহজিয়া, ইসলামের সুফী ও লোকায়ত দর্শনের সমন্বয়ে। ….. তাঁর গানের ভিত্তি বৈষ্ণববাদ হলেও তাকে শুদ্ধ বৈষ্ণববাদ বা শুদ্ধ সুফীবাদ কোনটাতেই ফেলা যাবেনা।’ সুফীবাদের প্রতি আকর্ষণের কারণেই হয়তো এ বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করেছে। মাঝেমধ্যে ও মেডিটেশন করতো। শেষ সময়টায় দেখতাম প্রায়ই মেডিটেশন করতো। সৃষ্টি, স্থিতি, সত্য-অসত্য, জগৎ ও মহাকাশ নিয়ে কৌতুহলের সীমা ছিল না। কখনো প্রশ্ন করতো, কখনোবা নিজেই উত্তরের খোঁজে পথ হাতড়ে বেড়াতো। সামগ্রিকতায় আস্থা ছিলো। নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগে লিখেছে।
আমি প্রস্তর হয়ে মরলাম উদ্ভিদ হতে
উদ্ভিদ হয়ে মরি, তো উত্থিত প্রাণে।
মানুষ হয়ে উঠলাম পরে, যখন সত্য উদ্ভাসিত হলো
ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?
১৯৯৫ এর ৫ অক্টোবর বিকেলে ত্বকী’র জন্ম। দিনটি ছিল বিজয়া দশমী। মৃত্যু ২০১৩ এর ৬ মার্চ। ঘাতকের জবানবন্দী থেকে জানাযায় ৬ মার্চ রাত ১১টায়ই ত্বকী’র র্মত্যু হয়েছে। দিনটি ছিল ফাল্গুনের ২২। ফাল্গুনের পথিক ত্বকী। অবশেষে ফাল্গুনের আগুনের ঢেউ বুকের কান্নার সাথে এসে মিশে গেলো, আরেক ফাল্গুনে।  #
লেখক – সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব ও ত্বকীর পিতা

নার্সারীতে সফলতা পেয়ে নার্সারী নুরুল ইসলাম সাত বার অর্জন করেছেন জেলা প্রশাসনের সম্মাননা পদক

ফেইসবুকে আমরা

এ সম্পর্কিত আরো খবর...

error: Content is protected !!
error: Content is protected !!