নারায়ণগঞ্জ  বৃহস্পতিবার | ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ | ২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ হেমন্তকাল | ১১ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

শিরোনাম
  |   পূর্বাচল লেকের পাড়ে উদ্ধার হওয়া পলিথিনে মোড়ানো খন্ড বিখন্ড মরদেটি কার ?    |   জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে র‍্যালী গণসমাবেশ    |   সোনারগাঁ বিএনপির উপজেলা ও পৌর কার্যালয় উদ্বোধন    |   সকল রুটে বাস ভাড়া কামানো দাবিতে ৪০২ জন আইনজীবীর স্মারকলিপি প্রদান   |   অটো চাপায় শিশু শিক্ষার্থী নয়ন তারা নিহত   |   ১২ দিনেও সন্ধান মেলেনি মিছিল থেকে হারিয়ে যাওয়া বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ইলিয়াস    |   জাতীয় বিল্পব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বন্দর থানা বিএনপি’র বর্ণাঢ্য র‍্যালী   |   দৈনিক খবরের পাতার সম্পাদকের পিতা ভাষা সৈনিক আবুবকর সিদ্দিকীর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী   |   শ্রমিক অসন্তোষে বিসিক শিল্প নগরীতে গার্মেন্টস ভাংচুর, সড়ক অবরোধ   |   ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম গ্রেপ্তার   |   ঐতিহাসিক বেতিয়ারা দিবস পালনে শহীদদের স্মরন করলো সমমনা    |   ফুলপাখি পাঠশালার ৪ দিনব্যাপী চিত্রকর্ম প্রদর্শনী শুরু    |   নারায়ণগঞ্জে মোহনা টিভির ১৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন   |   সোনারগাঁয়ে ব্যবসায়ীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তারের অভিযোগ   |   নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে হামলার ঘটনায় অধ্যাপক মামুন মাহমুদের নিন্দা   |   আড়াইহাজারে ভাঙচুরের মামলার দুই আসামি গ্রেফতার    |   মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ার সন্ত্রাসী হামলায় ৩ সহদোরসহ ৫ জন আহত   |   নিরীহ যুবককে আটক করে হত্যা মামলায় চালান   |   বদিউজ্জামান হত্যা মামলায় জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল কাদির গ্রেপ্তার   |   জেএসডি’র ৫২তম বার্ষিকী উপলক্ষে নগরীতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
 প্রচ্ছদ   কলাম   দশ বছর আগের একদিন : লাশকাটা ঘরে ত্বকী – মফিদুল হক
দশ বছর আগের একদিন : লাশকাটা ঘরে ত্বকী – মফিদুল হক
  কলাম || নারায়ণগঞ্জেরখবর.কম
প্রকাশিত: রবিবার, ৫ মার্চ, ২০২৩
মফিদুল হকঃ দশ বছর আগের একদিন লাশকাটা ঘরে শুয়েছিল ত্বকী, উত্তীয়-সম নবীন কিশোর, বয়স তাঁর তখনও আঠারোয় পা রাখেনি। শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খালে ৮ মার্চ পাওয়া গিয়েছিল তার মরদেহ, তারপর আইন ও বিচারধারা অনুসারে নিস্পন্দ ত্বকীকে নিয়ে যাওয়া হয় লাশকাটা ঘরে। উটের মতো গ্রীবা বাড়িয়ে কেউ দেখেনি লাশকাটা ঘরে কীভাবে শায়িত ছিল ত্বকী, তখনও কি তার দু’চোখ বিস্ফারিত ছিল মানুষের অতল নির্মমতা পাশবিকতার পরিচয় পেয়ে। আমরা জানি না, জানার চেষ্টা করাও দুরূহ কেবল জানতে পারি ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের রিপোর্ট, তিনি বলেছেন, শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তবে এর প্রয়োজন ছিল না। ত্বকীর মাথার তিনদিক থেকে আঘাত করা হয়েছিল, এই আঘাতই তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। এখানেই আমাদের থেমে যেতে হয়, আর কিছু জানা কঠিন হয়ে পড়ে, কিছু বুঝে-ওঠা মুশকিল হয়ে যায়। যেমন আমরা বুঝি না শব্দব্যবচ্ছেদকে কেন বলা হয় ময়নাতদন্ত, ময়না পাখির এখানে কী ভ‚মিকা! তবে বাস্তব বড়োই নির্মম, একই সাথে দলিত মানুষ বুঝি খোঁজে পাশবিকতা পেরিয়ে শীতল জলের আশ্রয়, ত্বকীর লাশ যেমন আশ্রয় পেয়েছিল নদীর জলে, একদা সবচেয়ে সুপেয় পানি হিসেবে যে শীতলক্ষ্যা নদীর সুনাম ছিল, এখন যে জল রাসায়নিক দূষণে, উন্নয়নের মূল্য পরিশোধ করে হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। এমনি বিষময়তার প্রকাশ ঘটিয়ে ঘাতকদের একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার সময় বলেছিল, গজারি কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ত্বকীকে অজ্ঞান করবার পর বুকের ওপর বসে গলা টিপে তার শ্বাসরোধ করা হয়। ডাক্তার বলেছিল মাথার তিনদিকের আঘাতই মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। ত্বকী তো বয়সের তুলনায় একটু বেশি ছিল সচেতন ও অনুভ‚তিপ্রবণ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ সে পড়েছিল, তেমনি পড়েছিল নীটশের রচনার অনুবাদ ‘জরথুস্ত্র বলছেন’। জীবনানন্দের কবিতা তখনও তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছে কিনা জানা নেই, তবে অন্তরে পরম বেদনার সুর সে নিশ্চয় বহন করতো, নতুবা কেন সে ছিল এমন মৃদুভাষী, নম্রকণ্ঠ, কাউকে কষ্ট দিতে অপারগ, দেখছে চারপাশের জগৎ, শুষে নিতে চাইছে জীবনের মহিমা, খেরোখাতায় লিখছে কবিতা, স্কুলের রচনায় স্বপ্নের কথা, যে স্বপ্ন সমষ্টিমঙ্গলের।
কে হত্যা করেছে ত্বকীকে? পুলিশ নিশ্চিতভাবে তাদের চেনে, র‌্যাবের তদন্তে আরো জানা গেছে হত্যাকারীদের পেছনে কারা ছিল, কী কারণে তারা অপাপবিদ্ধ এই কিশোরকে এমনভাবে দুনিয়া থেকে চিরতরে উধাও করে দিতে চাইলো। কাগজে-কলমে ত্বকী হত্যাকারীদের আমরা চিনি না, যদিও জানি ৬ মার্চ বিকেলে সুধীজন পাঠাগারে যাবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল এই বালক কিশোর। বহু মানুষের বহু যতেœ বন্দর শহর নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠেছে এই পাঠাগার, সত্যিকার অর্থেই সুধীজনের দ্বারা নির্মিত। বন্দর ও গঞ্জ, দুই-ই জড়িত এই শহরের নামের সঙ্গে, যে-দুইয়ের সঙ্গে আছে অর্থ, প্রতিপত্তি, তরক্কি ও ক্ষমতার যোগ। ত্বকী পৌঁছতে চেয়েছিল সুধীজন পাঠাগারে, অন্যদিকে আছেন অনেক প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, ক্ষমতাধর পরিবারের সদস্য, আছেন তাদের অনুসারী যুবাদল, গুরুর হাতের সামান্য ইশারাতে যারা করে ফেলতে পারেন অনেক দুঃসাধ্য কাজ। পাঠাগারে তারা প্রবেশ করতে পারে না, প্রবেশে আগ্রহী নয়, তবে পাঠাগারের পথের বালককে তুলে নিতে পারে দিবালোকে, হরণ করে যেখানে নিয়ে যেতে পারে সেখানেও আছে এক কেন্দ্র, অন্যতর এক সমাবেশ, নামে ক্লাব, তবে চালচরিত্রে একেবারে আলাদা। কে হত্যা করেছে ত্বকীকে আমরা জানলেও অভিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের নাম উচ্চারণ করা যাবে না, আইনের ছাতা মেলে হুঙ্কার দেবে ক্ষমতাধর, সে হুঙ্কারে যত তেজ ততই প্রকাশ পায় ভেতরের দুর্বলতা। অভিযুক্ত যদি কখনো কেউ হয়ে থাকেন, তাহলেও বিচার-সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি নির্দোষ হিসেবে গলা ফুলিয়ে বন্দর কাঁপাতে পারবেন। কিন্তু আড়ালে তো সত্য হাসে, আর সেই সত্য কতভাবেই না নিজেকে প্রকাশ করছে।
দশ বছর আগের একদিন শীতলক্ষ্যার বুক থেকে তুলে লাশকাটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ত্বকীকে, সেই থেকে জীবনানন্দীয় বাস্তবতায়, উপলব্ধির নিবিড়তায় ত্বকীর কোনো বিনাশ নেই। হত্যাকারী এবং তাদের যারা পৃষ্ঠপোষক, তারা বুঝেছিলেন লোকস্মৃতি বড়োই চ ল, বিস্মৃতিপ্রবণ, সময়ের প্রবাহ মুছে দেবে সব রক্তচিহ্ন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের জনমানসে ত্বকীর অবস্থান তো কিছুতেই মুছে যাওয়ার নয়। বছরান্তে শীতলক্ষ্যার জলে ত্বকী স্মরণে ভাসিয়ে দেয়া হয় প্রদীপবাহী ছোট ভেলা, খোয়াজ-খিজিরের স্মরণে জীবনের সকল দুঃখজয়ের প্রার্থনা নিয়ে যেমন জলপ্লাবিত বাংলার মানুষ ভাসান-যাত্রার উৎসবে মিলিত হয়।
ত্বকীর স্মরণে প্রতি বছর আয়োজিত হয় জাতীয় ভাবে শিশু-চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান। যে-শিশুরা গোড়ায় যোগ দিয়েছিল তারা তখন তরুণ, ত্বকীর মতোই স্বপ্নভরা চোখে চলছে জীবনে পথে। ত্বকী স্মরণে যে গান গীত হয়েছে, পাঠ করা হয়েছে কবিতা, তুলে আনা হয়েছে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা তা ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে। সেই সুর সেই ¯পন্দ রোধ করে সাধ্য কার! তবে সবচেয়ে বড় কথা, ত্বকী-হত্যার ক্ষত কেবল একটি হত্যাকাÐের বেদনা হয়, যদিও একটি মৃত্যুর বেদনার পরিমাপ গ্রহণও দুঃসাধ্য। ত্বকী হত্যার পূর্বাপর বাস্তবতা দেখিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতার জোরে কারা আইনের শাসন পথভ্রষ্ট করতে পারে, নিজেদের হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য কারা জাতির জনকের নামাবলি গায়ে দিতে পারে, শহীদের রক্তরঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বুলি আউড়ে যেতে পারেন হরহামেশা, নিজেদের কর্মকাÐ ও আচার-আচরণ আড়াল করতে জাতির সুকৃতি ও অর্জন ভাঙিয়ে চলতে পারেন তারা, সম্পদের বাজারে দাপটের সঙ্গে বেচাকেনা করতে পারেন, পারেন আইনকে তার চলার পথে থামিয়ে দিতে। তবে এতোকিছুর পরও তারা শীতলক্ষ্যার জল থেকে ত্বকীকে তুলে আনতে পারেন না, খোয়াজ-খিজির ব্রতপালনে হিন্দু-মুসলমান নারী-পুরুষের ভাসানযাত্রার গান তো ফিরে ফিরে গীত হবে, প্রদীপ শিখা জলে ভাসবে, স্মৃতিতে দুলে উঠবে ত্বকী। লাশকাটা ঘরে পড়ে থাকবে থেঁতলানো দেহ, ময়নাতদন্ত শেষ হলেও বিচার তো শেষ হয়নি, শেষ তো দূরের কথা, শুরুই হয়নি। শুরুই-বা হবে কি করে চার্জশিটই তো দেওয়া হয়নি। আর তাই লাশকাটা ঘর যেমন জীবনানন্দ দাশের কবিতা হয়ে বাঙালি চিত্ত তাড়িত করে ফেরে, অবিরত তেমনি নবীন কিশোর ত্বকী পড়ে থাকে লাশকাটা ঘরে, মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের গুলিবিদ্ধ মিছিলকারীদের মতো প্রত্যাখ্যান করে কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার নিয়তি।
দশ বছর পেরিয়ে গেলেও ত্বকী হত্যার বিচারের দাবি হারিয়ে না গিয়ে বরং আরো শক্তিময়তা নিয়ে জেগে উঠছে। আমরা সমাজে এমনি দুরাচারের বিস্তার লক্ষ্য করছি, রাজনীতির সঙ্গে দুর্বৃত্তের সংযোগ জন্ম দিচ্ছে বহু ধরনের অপরাধের। এর ফলে সদর্থক রাজনীতি হারিয়ে ফেলছে নৈতিক অবস্থান, ক্ষয়িত হচ্ছে মানুষের মনে তার অবস্থান। আজ বাংলাদেশকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর ঘুরে দাঁড়াবার ক্ষেত্রে সফলতা-বিফলতা নির্ধারণ করে দেবে আগামী দিনের রাজনীতির ভাগ্য। ত্বকী হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে সেটা আমাদের সবার জন্য হবে আস্থার পুনর্বাসন, ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা। এই বার্তার অপেক্ষায় কেটে গেছে দশ বছর। আর বিলম্ব সমাজের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলকর হবে না। নিপাত যাক দুর্বৃত্তের জয় বাংলা, আকাশ-বাতাস কম্পিত হোক মানুষের জয় বাংলায়।
মফিদুল হকঃ লেখক, ট্রাষ্টি, মু্িক্তযুদ্ধ জাদুঘর।

নার্সারীতে সফলতা পেয়ে নার্সারী নুরুল ইসলাম সাত বার অর্জন করেছেন জেলা প্রশাসনের সম্মাননা পদক

ফেইসবুকে আমরা

এ সম্পর্কিত আরো খবর...

error: Content is protected !!
error: Content is protected !!