শিরোনাম
আমাদের কান্নায় ত্বকীর চিরশয্যা – হায়াৎ মামুদ
হায়াৎ মামুদঃ আমাদের বাংলাদেশের সমাজে অমানবিকীকরণ কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে প্রতিদিন দৈনিক সংবাদপত্রে চোখ রাখলে তা স্পটভাবে ধরা পড়ে। কিন্তু ডাক্তার যেমন মুমূর্ষু রোগী ও মৃতদেহ দেখতে-দেখতে মৃত্যু বিষয়ে নিস্পৃহ ও কৌত‚হলহীন হয়ে যান, আমরা সাধারণ মানুষজনও তেমনি আমাদের সামাজিক পরিমন্ডলে অমানবিক ঘটনা চাক্ষুষ করেও ক্রমাগত শুনতে থাকার কারণে অনুভ‚তির নিঃসাড়তা অর্জন করে ফেলি। পরিচিত পরিমন্ডলে অবশ্য তেমন পরিস্থিতি ঘটলে আমাদের অসাড়ত্ব মুহূর্তে ঘুচে গিয়ে আমরা বিপন্ন ও নিরাশ্রয় হয়ে উঠি। তখন শিহরিত হয়ে ভাবি, আমার নিজের পরিবারে যদি এমনটা ঘটত, ভাগ্যিস ঘটেনি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাঁফ ছাড়ি হয়ত, কিন্তু স্থির থাকতে তো পারি না। দশ বছর আগে এমন একটি কান্ড নারায়ণগঞ্জ শহরে ঘটে গেল যার নিষ্ঠুরতা ও মর্মান্তিকতা আমাদের শুধু নির্বাকই করেনি, আমাদের চ‚ড়ান্ত অসহায়ত্বও বুঝিয়ে দিয়ে গেল।
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী নামটি আগে আমার অচেনা ছিল। তার বাবা রফিউর রাব্বি আমাদের অনুজপ্রতিম বন্ধু, নারায়ণগঞ্জে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় সুপরিচিত প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় যারা নারায়ণগঞ্জবাসীকে জিম্মি করে রেখেছে সেই একটি বিশেষ পরিবারের বিরুদ্ধে রফিউর রাব্বির কণ্ঠ সর্বদাই সোচ্চার ছিল, এখনও আছে, তাঁর পুত্রহত্যার কারণে আরো তীক্ষè ও গগনবিদারী হয়েছে। এই পরিবারটির দুর্বৃত্তগিরির কারণে ঐ শহরের সকলেই সর্বক্ষণ ভীতসন্ত্রস্ত থাকে, তাদের নাকি নির্যাতন কক্ষ বা ‘টর্চার সেল’ পর্যন্ত আছে এবং বর্তমান সরকারের কেষ্টবিষ্টুরা সবাই সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, অথচ নিজেদের কার্যসিদ্ধি হয় বলে কেউই উচ্চবাচ্য করেন না। কী লজ্জা ও গøানিকর! শেখ হাসিনা কি তা জানেন না? সকলের ধারণা, তিনি জানেন এবং জেনেও নিশ্চুপ থাকেন, কারণ তিনি কিছু বললে তাঁর পক্ষপুষ্ট লোকজনদের অসুবিধে হতে পারে। দু’দিন নিখোঁজ থাকার পর ৮ মার্চ ২০১৩ তারিখে মাত্র ১৭ বছর বয়সী এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এ-লেভেলের শিক্ষার্থী মেধাবী এই তরুণ ছাত্রের লাশ পাওয়া গেছে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে। তার এভাবে নিহত হওয়ার কারণ তার নিজের কোনো কর্মকান্ড নয়, তাকে প্রাণ দিতে হল তার উদ্যমী ও বিদ্রোহী পিতার কারণে। নিষ্পাপ এই তরুণের মৃত্যু ঘটানো হল তার পিতাকে শাস্তি দানের জন্য। এমন অন্যায় ও কাপুরুষোচিত কাজ কাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরে কারো নিকটেই তা অজানা নয়। রফিউর রাব্বি এমন ব্যক্তিগত সর্বনাশেও কিন্তু দমে যাননি, এরপরেও তিনি বলেছেন : ‘যদি বাসভাড়া কমানোর বিষয়টি অপরাধ হয়ে থাকে, যদি ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে রেলওয়ের ভ‚মি রক্ষা করা অপরাধ হয়ে থাকে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করাটা অপরাধ হয়ে থাকে, যদি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাওয়াটা অপরাধ হয়ে থাকে- তবে এই অপরাধ আমৃত্যু করে যাবো।’ তাঁর এই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এতখানিই সৎ-সাহসের পরিচয় দেয় যে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নুয়ে আসে।
কী বর্বর এই হত্যাকান্ড পিতাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পুত্রকে হত্যা করা। নারায়ণগঞ্জের সকলের ঘৃণা এখন সেই পরাক্রমশালী আওয়ামী লীগপন্থী পরিবারটির প্রতি ফেটে পড়েছে। আমরা রফিউর রাব্বির শোক-সন্তপ্ত হৃদয়ের প্রতি সমবেদনা জানাই। চাই যে, তাঁর শোক প্রশমিত হোক এবং অন্যায়কারীদের প্রতি তাঁর ক্রোধ ও ঘৃণায় অংশ নিক সমগ্র নারায়ণগঞ্জবাসীই শুধু নয়, বরং দেশের সমুদয় জনগণ। আমরা বিশ্বাস করি এবং প্রত্যক্ষ করছি পুত্রশোকগ্রস্ত পিতা রফিউর রাব্বি কুণ্ঠাহীন সাহস ও তেজে পূর্বের চেয়ে আরো বহুগুণ বেশি সক্রিয় নারায়ণগঞ্জের এই দুর্বৃত্ত পরিবারটির বিরুদ্ধে। তাঁর যুদ্ধ তাঁর একার লড়াই নয়, আমাদের সকলেরই লড়াই- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে সন্ত্রাসমুক্ত করতেই হবে, নইলে আমরা কেউই শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারব না।
লেখক : শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক।