ভাওয়াল রাজবাড়িটিও বেশ আকর্ষণীয়!
‘নামে কী আসে যায়!’ শেক্সপিয়র ‘রোমিও এন্ড জুয়িয়েট’ নাটকে লিখেছেন ঠিকই কিন্তু বাস্তবে তো আসে যায়! ব্যক্তির নামে যেমন, স্থানের নামেও কখনো কখনো অনেক কিছুই আসে যায়! বর্তমান গাজীপুরও এক সময় ভাওয়াল, পরবর্তী সময়ে জয়দেবপুর, এরপর গাজীপুর এভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রতিটি নামকরণের ইতিহাসের পেছনে আছে ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস এবং ঘটনা। থাকে একাধিক গল্প, মিথ কিংবা কিংবদন্তী।ঢাকার খুব সন্নিকটে হওয়ায় ঘুরে বেড়ানোর তালিকায় বারবার চলে আসে কাছের জেলা গাজীপুর। ১৭০৪-এ পত্তন হওয়া বিশাল ভাওয়াল এস্টেট বাড়তে বাড়তে শেষে যার আয়তন দাড়ায় প্রায় ১৫০০ বর্গকিলোমিটার। রাজবাড়িটিও বেশ আকর্ষণীয়! রাজবাড়ির বিভিন্ন ভবন ও স্থানকে বড়ো দালান, রাজবিলাস, পদ্মনাভ, হাওয়া মহল, পুরান বাড়ি এভাবে ভাগ করা হয়েছে। ভেতরে রয়েছে বিশাল দীঘি, যা এখন দখল হতে হতে ছোট হয়ে এসেছে। দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে যেদিকেই দৃষ্টি দেই শুধু ছোট-বড় ভবন আর ভবন। বাড়ির ভেতরেই রয়েছে চমৎকার একটি নাটমন্দির। খানিকটা দূরে শ্মশান ও মন্দির। কারুকার্যময় বিশাল মন্দির আজো ভাওয়াল রাজাদের ক্ষমতা ও বিত্তের স্মারক হয়ে আছে।সব কিছু ছাপিয়ে ভাওয়াল রাজাবাড়ি বেড়াতে এলে যে ঘটনা আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে তা হচ্ছে সন্ন্যাসী রাজার কাহিনি। মেজো কুমার রামেন্দ্র নারায়ণ রায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে হাওয়া বদলের জন্য তাঁকে দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাঁর মৃত্যু ও অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার পরও রহস্যজনকভাবে ১২ বছর পর আবার ফিরে আসার নাটকীয় কাহিনি এখনো লোকমুখে ফেরে। রামেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সন্ন্যাসীরূপে ফিরে আসায় তাঁকে তাঁর স্ত্রী ও স্ত্রীর ভাই ‘প্রতারক’ বলে ঘোষণা দেন। সন্ন্যাসী রাজা ও তাঁর বোন জ্যোতির্ময়ীর করা মামলা ভারতবর্ষে খুব আলোচিত একটি মামলার ঘটনা। দুই দফায় ১৯৩০ সালে শুরু হওয়া মামলা ১৬ বছরে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় ১৯৪৬ সালে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে। শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসী রাজার পক্ষেই চূড়ান্ত রায় আসে। ভাওয়াল রাজার ঘটনাকে ভিত্তি করে ‘সন্ন্যাসী রাজা’ উত্তম কুমার অভিনীতি জনপ্রিয় সিনেমা। ২০২২ সালের জানুয়ারী মাসে শীতের সকালে কমলাপুর থেকে ট্রেনযোগে জয়দেবপুর আসি। দুপরের আহার শেষে রিকশা নিয়ে চলে আসি ভাওয়াল রাজ বাড়িতে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হওয়ায় বিধিনিষেদের বেড়াজালে অফিস সময়ে গেলে বেড়ানোর মেজাজ থাকে না। সবচেয়ে ভালো বন্ধের দিন শুক্র বা শনিবার বেড়াতে যাওয়া। বিশাল রাজবাড়ির ৩৬৫টি কক্ষই এখন জেলা প্রশাসকের বিভিন্ন অফিস, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, আইনজীবী-সেরেস্তাদারদের কক্ষ, পুলিশ, বাদী-বিবাদীদের নিত্য আনাগোনায় মুখর। এই রাজবাড়ি এখন জেলার যাবতীয় প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশে বহু ঐতিহ্যবাহী স্থান অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে হয় সরকারী কার্যালয় অথবা বাসবভবন হিসাবে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে! অন্যান্য অনেক স্থাপনার মতো এটিও হতে পারতো আকর্ষণীয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ভাওয়াল রাজবাড়ির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শনের চূড়ান্ত বারোটা বাজিয়ে বর্তমান সরকারী কার্যালয় স্থানান্তর করা হবে। একইসাথে সুরম্য এই ভবনটিকে “আাকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র” হিসাবে ঘোষণা করা হবে!গাজীপুরের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রাচীন এই গাজীপুর জেলার মাটির ঊর্বরতার পেছনে এক সময়ের স্রোতস্বিনী লবলং, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, বানার, তুরাগ, বালু, মালদহ প্রভৃতি নদীর বিপুল জলরাশির বয়ে আনা পলিমাটির একটা ভূমিকা আছে। প্রাচীনকালের এসব নদীর নাম এখন আর প্রচলিত নয়। অনেক নদীর অস্তিত্বই আর নেই। প্রায় আড়াই হাজার হতে তিন হাজার বছর পূর্বের জনপথ সাকেশ্বর, ভাকুরাই ছড়া ও টোক, কপালেশ্বর, দরদরিয়া একঢালা, বজ্রপুর (বর্তমান বক্তারপুর), চিনাসুখানিয়া, শৈলাট, দিঘলীর ছিট ইত্যাদি প্রাচীন প্রত্মতাত্ত্বিক অঞ্চল তারই সাক্ষ্য বহন করে। প্রাচীনকাল থেকে শালবন ঘেরা এই সমৃদ্ধ জনপদ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে কালক্রমে ছোট-বড় সভ্যতাগুলো আজ বিলুপ্ত।গাজীপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে জানা যায় মধ্যযুগে চৌড়া, ধীরাশ্রম, কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ, জয়দেবপুর, কাশিমপুর, টঙ্গী প্রভৃতি স্থানে সমৃদ্ধ নগরকেন্দ্রিক, কৃষি ও শিল্প-বাণিজ্য নির্ভর জনপদ গড়ে উঠেছিল। যথাযথভাবে খনন কাজ করলে হয়তো আবিষ্কৃত হবে আরো বহু লুপ্ত ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। সম্রাট অশোকের আমলের সাকেশ্বর স্তম্ভ, বৌদ্ধ আমলের ভবাক ও ভাকুরাই নামে জনপদীয় শাসন, মৌর্য শাসনামলে নির্মিত দরদরিয়া দুর্গ, ঢোল সমুদ্রের বৌদ্ধ বিহার জেলার প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গাজীপুর আরো কয়েকটি কারণে বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে আমাদের। এই অঞ্চলেই বাংলা ভাষায় প্রথম অভিধান ও ব্যাকরণ বাংলা পর্তুগীজ শব্দকোষ ১৭৩৩ সনে রচিত হয়েছিল। এটি রচনা করেন পুর্তগীজ পাদ্রী মনো এল দা আসসুম্পাসউঁ। বাংলা গদ্যেরও সুতিকাগার এই গাজীপুর জেলা। ১৭৩৩ সালে পাদ্রী দোম অমেত্মানিয় দো রোজারিও ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ রচনা ও প্রকাশ করেন গাজীপুরে বসেই। এটি বাংলা সাহিত্য ও ভাষার প্রথম গদ্যে মুদ্রিত বই বলে স্বীকৃত। কাপাসিয়ার তিতবাটি নামক গ্রামে তৈরি হতো বাংলার মসলিন কাপড়। বরমী বাজারের নিকটে ছিল দেশের সর্ববৃহৎ গ্রামীণ পণ্য বাজার।বেশ কয়েক বছর পূর্বে কোনো এক বড়দিনে নাগরী ও কালীগঞ্জ অঞ্চলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। পুরো এলাকাই খ্রিস্টান অধ্যুষিত। হেঁটে হেঁটে আমরা খ্রিস্টান পল্লীগুলো যখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তখন স্মরণ করছিলাম পুর্তগীজ সেই পাদ্রীকে যিনি ধর্মীয় কারণে বাংলাভাষার প্রথম অভিধান প্রণয়নে মনোনিবেশ করেছিলেন। খ্রীস্টান ধর্মের বাণী পৌঁছানোর লক্ষ্য ছাড়াও এই অভিধান করা হয়েছে উপনিবেশ বিস্তারের লক্ষ্যে অর্থাৎ প্রশাসনিক এবং ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটাতেও। উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও অলক্ষ্যে এই পাদ্রী বাংলাভাষা প্রসারে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলকও তৈরী করে যান।সন্ধ্যায় বাস ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। নানা রকম উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও নগরায়ন প্রসারের ফলে গাজীপুর এখন ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যস্ত একটি অঞ্চল। এক সময়কার ভাওয়াল গড় ছিল ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। নানা ধরণের প্রাণী বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল জঙ্গল। ডোরাকাটা বাঘ, চিতাবাঘসহ বহু প্রাণী বেশ আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক এবং তার সন্নিকটে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত নুহাশপল্লী অথবা জাতীয় উদ্যানে বেড়াতে বেড়াতে সেই প্রকৃতিরই ভগ্নাবশেষে টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মনে হবে আমাদের। লুপ্ত প্রকৃতির অনেক কিছুই আর ফিরে আসবে না। তারপরও আন্তরিকতা ও সততা নিয়ে এগিয়ে আসলে এখনো অনেক কিছু রক্ষা করা নিশ্চয়ই যায়।