নারায়ণগঞ্জ  সোমবার | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ শীতকাল | ২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬

শিরোনাম
  |   বাংলাবাজারে জাকের পার্টির মিশন সভা ও জলছা মাহফিল অনুষ্ঠিত   |   আড়াইহাজার বাজারে হাত-পা বেঁধে ৪ দোকানে ডাকাতি   |   নারায়ণগঞ্জ ক্লাব নির্বাচনে জয়ি হওয়ায় ভোটারদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন হৃদয়    |   ১২ মামলার আসামী সালামের চেয়ারম্যানের ডান হাত সন্ত্রাসী সোহেল বাহিনী বেপরোয়া    |   নিহত মেধারী শিক্ষার্থী ওয়াজেদ সিমান্ত হত্যার বিচার কার্যকর ও নিরাপত্তার দাবিতে মানববন্ধন   |   জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হলেন মমিনুর রশিদ শাইন    |   জাতীয় পরিবেশ মানবাধিকার সোসাইটির শীতবস্ত্র বিতরণ | জেলার নতুন কমিটি ঘোষনা    |   পূর্বাচলের লেক থেকে অজ্ঞাত তরুণীর মরদেহ উদ্ধার   |   মহান বিজয় দিবসে রূপগঞ্জে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আলোচনা সভা   |   নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনের সাবেক এমপি এস.এম. আকরামের মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা    |   তারেক জিয়া নেতৃত্বে দেশবাসীকে একটি নতুন বাংলাদেশ উপহার দিব- মুকুল   |   মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান ও প্রীতি ফুটবল প্রতিযোগিতা    |   শহীদ বুদ্ধিজীবী  দিবসে বন্দরে বধ্যভূমিতে উপজেলা প্রশাসনের পুষ্প অর্পন    |   বিপিজেএ না’গঞ্জ কমিটির সাক্ষাৎ / অপসাংবাদিকতা পরিহারের আহবান জানালেন – হাতেম   |   লায়ন্স ক্লাব ১৮০০ মানুষকে সেলাই মেশিন, ভ্যানগাড়ি, শীতবস্ত্র, স্কুল ব্যাগ বিতরন সহ স্বাস্থ্যসেবা দিল   |   জাতীয়তাবাদী গার্মেন্টস শ্রমিকদলের নারায়ণগঞ্জ জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত   |   বিএনপির ৩১ দফার সমর্থন আদায়ে সোনারগাঁওয়ে উঠান বৈঠক   |   আড়াইহাজারে ৮ কেজি গাজা সহ গ্রেফতার ২    |   রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, না’গঞ্জ জেলার আলোচনা সভা   |   নারায়ণগঞ্জ ফটো জার্নালিস্টস এসোসিয়েশন নবগঠিত কমিটিকে বন্দর প্রেসক্লাবের শুভেচ্ছা
 প্রচ্ছদ   কলাম   বীর মুক্তিযাদ্ধা মীর আমান উল্লাহ এক উদাহরণ – বিমল কান্তি দাস
বীর মুক্তিযাদ্ধা মীর আমান উল্লাহ এক উদাহরণ – বিমল কান্তি দাস
  কলাম || নারায়ণগঞ্জেরখবর.কম
প্রকাশিত: শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
এক.
বিমল কান্তি দাসঃ একজন মার্কসবাদীর কতটুকু নৈতিকতা অর্জন করা উচিত, কতটুকু সততা থাকা উচিত তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ মীর মোঃ আমান উল্লাহ। সমাজবদলের রাজনীতিতে তাকে একটা মডেল ধরা যায়। কিভাবে একজন ভালো কমিউনিস্ট হওয়া যায় তা মীর মোহাম্মদ আমান উল্লাহর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। পদ-পদবীর দিক থেকে তিনি খুব বড় মাপের নেতা ছিলেন না কিন্তু মতাদর্শগতভাবে তিনি অনেক বড় মাপের ছিলেন। তার জীবন ও কর্ম নতুন প্রজন্মের কমরেডদের সামনে তুলে ধরতে পারলে, তার বলিষ্ঠ চরিত্রকে সাহিত্যে রূপদান করতে পারলে তা থেকে সমাজ বদলের সংগ্রাম উপকৃত হবে। মীর মোঃ আমান উল্লাহ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের কমিউনিস্ট আন্দোলনে গোপাল বসাক, অনিল মুখার্জি, নেপাল নাগ, প্রাণগোবিন্দ গুণ, সুনীল রায়, হেনা দাস, সুবিদ আলী, লাল মিয়া ও শহিদ তাজুলের মত বিপ্লবীরাও এ অ লে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু শিক্ষা নেবার আছে। শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, এরা এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস হয়ে থাকবে। তাদের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নিতেই হবে।
দুই.
মীর আমান উল্লাহ ১৯৪৭ সালের ২ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলার গোদনাইল মীর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলমাস আলী অঢেল সম্পদের মালিক ছিলেন। মাতা জাহানারা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি ছিলেন বাবার একমাত্র সন্তান। বলা যায় সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দাদা মীর আবদুল ওয়াহেদ এলাকায় একজন দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অনেক জায়গাজমি ছিল তার। বয়স যখন ৯ মাস তখন তার বাবা নারায়ণগঞ্জ শহরে বাসা নেন। সে কারণে তিনি নারায়ণগঞ্জের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বড় হয়েছেন। ওই সময়ে তার বাবা নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় একটি বড় পদে চাকরি করতেন। তার মামাবাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জের এসিআই পানির কল এলাকায়। সে আমলে তার নানাবাড়ির প্রায় সবাই আধুনিক চিন্তা ও সংস্কৃতির মানুষ ছিলেন। ছোট বেলায় বড় ওস্তাদের কাছে সেতার বাজানো শিখেছিলেন। স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন, নাটক লিখতেন, নাটকে অভিনয় করতেন, পরিচালনাও করতেন। কৈশোরে সাংস্কৃতিক জগতের মানুষের সাথে তার চলাফেরা ছিল বেশি। তখন থেকেই তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক চিন্তা ও দর্শন এর সাথে পরিচিত হন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। নারায়ণগঞ্জের দ্বিতীয় খেলাঘর সংগঠন ‘ঝিলিমিলি খেলাঘর আসর’ গড়ে উঠেছিল ১৯৬৮ সালে। প্রথম থেকেই তিনি এই খেলাঘরের সাথে যুক্ত ছিলেন। এটা ছিল গোদনাইল এলাকায়। এ শাখাটি আজও আছে। নারায়ণগঞ্জ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শুরু থেকেই তিনি যুক্ত ছিলেন। এলাকায় তার দাদার দেওয়া স্কুল গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নাটকের রিয়ার্সেল করতেন। এখানে তিনি বহুবার নাটক করেছেন।
তিন.
প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা ও কমিউনিস্ট নেতা সুনীল রায় গোদনাইল-আদমজী শিল্পা লে ১৯৪০, ৫০ ও ১৯৬০ দশকে শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে তিনি মাঝে মাঝে মীর আমান উল্লাহর বাবার সাথে মীর বাড়িতে আলোচনা করতে আসতেন। সুনীল রায় যখন তার বাবার সাথে আলোচনা করতেন তিনি (আমান উল্লাহ) সে আলোচনা মনোযোগের সাথে শুনতেন। সুনীল রায়ের আলোচনা শুনতে শুনতে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল বেআইনি ও নিষিদ্ধ। কাউকে না জানিয়ে তিনি সুনীল রায় এর সাথে গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকাÐে যুক্ত হয়ে পড়েন, বাড়ির মানুষ একথা অনেক পরে জানতে পারে। পার্টি গোপন থাকার কারণে প্রকাশ্যে তিনি এলাকায় ন্যাপের মধ্যে থেকে কাজ করতেন। ১৯৭৩ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক আন্দোলনে এলাকায় সকল প্রকার সহযোগিতা ছিল তাঁর। তখন সুনীল রায় ছিলেন এ অ লের শ্রমিক আন্দোলনে এক কিংবদন্তি। একটা সময়ে আমান উল্লাহ ছিলেন তার প্রধান সহযোগী। তিনি কখনোই নিজে পদ-পদবী বা নেতা হতে চাইতেন না। তারমধ্যে নেতৃত্বের লোভ বা প্রদর্শনবাদ ছিল না। নাম প্রচারে তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। সহকর্মীদের প্রতি একটু বেশি বিনয় ছিল তার স্বভাবের মধ্যে। এলাকার সাধারণ মানুষ তাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ তাকে বেশি পছন্দ করতেন, ভালোও বাসতেন। এলাকার সাধারণ মানুষ বিপদে আপদে তার কাছে পরামর্শের জন্য আসতেন। তারা বলত আমান উল্লাহ একজন আদর্শবান মানুষ, নীতিবান মানুষ।
রাজনীতিতে উল্লেখ করার মতো তাঁর বহু আলোচিত ঘটনা আছে। ১৯৬৫ সালে কয়েকজন বন্ধু মিলে গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে একটি শহীদ মিনার করার পরিকল্পনা করেন। তখন তোলারাম কলেজ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে আশেপাশে কোন শহীদ মিনার ছিল না। তখনকার সরকার ও সরকারি দল মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কোথাও শহীদ মিনার করতে দেওয়া হতো না। মীর আমান ও তার ছয় সহযোদ্ধা মিলে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যভাগে কোনো এক শীতের রাতে হঠাৎ গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পরিকল্পিত সেই শহীদ মিনারটি তৈরি করে ফেললেন। স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আমান উল্লাহ ও তাঁর সহযোদ্ধারা স্থানীয় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তা রক্ষা করেন। ১৯৬৬ সালের একুশে ফেব্রæয়ারি তাঁদের এই তৈরি করা শহীদ মিনারে শহীদ দিবস উদযাপন করা হয়েছিল। তখনকার সময়ে শহীদ মিনার তৈরি করা ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ ধরনের বহু বীরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাবলী তার অনেক কর্মকাÐে পাওয়া যাবে।
চার.
মীর আমান উল্লাহ জন্মগতভাবেই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। জ্ঞান হবার আগেই পিতা আলমাস আলী গান শোনানোর জন্য কলেরগান গ্রামোফোন কিনে দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় একজন ভালো ওস্তাদেরদের কাছে সেতার বাজানো শিখেছিলেন। স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন, গান গাইতেন। নারায়ণগঞ্জের প্রথম অথবা দ্বিতীয় খেলাঘর আসর তাদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। সেই ‘ঝিলিমিলি খেলাঘর’ আজো তাদের এলাকায় টিকে আছে। নারায়ণগঞ্জে উদীচী এর জন্মলগ্ন থেকেই যুক্ত ছিলেন। তিনি শহরে বসবাস করতেন না। তার বাড়িটি ছিল শহর থেকে একটু দূরে। কোনো অনুষ্ঠান বা সভা সমাবেশে তিনি নিজেকে প্রদর্শন করতে চাইতেন না। সব সময় একটু পেছনের সারিতে বসতেন। হয়তোবা এসব কারণে বড় কোনো পদ-পদবিতে তিনি থাকতে পারেননি। তার নাম প্রচার কখনো তেমন একটা হয়নি। যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা জানেন- তিনি ছিলেন আপাদ-মস্তক সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ। পরবর্তী জীবনে শ্রমিক আন্দোলন ও রাজনীতিতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক কাজে কাক্সিক্ষত ভ‚মিকা রাখতে পারেননি। ছোটবেলায় নাটকের বিভিন্ন সংগঠন করেছেন। খেলাঘর, উদীচী ছাড়া একটা গানের সংগঠনও তিনি চালাতেন। লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর জীবন ছিল কিছুটা অগোছালো প্রকৃতির। লেখাগুলো সংরক্ষণ করেননি। আমি জানতাম তার অনেক কবিতা, নাটক ও প্রবন্ধ লেখা আছে কিন্তু মৃত্যুর পর তেমন একটা খুঁজে পাওয়া গেল না। শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে তার সাথে অনেক কথা হয়েছে। তিনি অনেক কিছু জানতেন, বুঝতেন। তিনি যা বুঝতেন তা মনেপ্রাণে ধারণ করতেন। যারা কমিউনিস্ট পার্টি করেন তারা সংস্কৃতিমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে থাকেন। আমান ভাই ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক ও শতভাগ অস¤প্রদায়িক একজন মানুষ। তার মতো এক ঝাঁক আদর্শবান ও সংস্কৃতিমনা মানুষ সমাজ বিপ্লবের জন্য একান্ত প্রয়োজন।
পাঁচ.
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমান উল্লাহ নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল এলাকাতেই ছিলেন। পার্টির পক্ষ থেকে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আদমজী- গোদনাইল- জালকুড়ি অ লের স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য। ভারত থেকে ট্রেনিং দিয়ে অস্ত্র নিয়ে যারা দেশে ফিরতেন সেই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ও তাদের থাকার ব্যবস্থা করতেন। এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ও খবরাখবর আদান প্রদানের দায়িত্বে থাকতেন। স্ত্রী মাসুদা সুলতানাও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ দায়িত্ব পালন করেছেন। আমান উল্লাহ ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ভালো জানতেন, ফলে এই কাজগুলো তার পক্ষে সহজ হত। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে রাস্তাঘাটে নিরাপদে চলাচল করতে পারে তার জন্য ২নং ঢাকেশ্বরী মিলের শ্রমিকদের আইডি কার্ড নকল করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। ঢাকেশ্বরী মিলের ঔষধের গোডাউন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঔষধ দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে যুদ্ধে অপারেশনেও থাকতেন। ছাত্র ইউনিয়ন- কমিউনিস্ট পার্টি- ন্যাপ এর গেরিলা বাহিনীতে জালকুড়ি এলাকার শত শত যুবক কমরেড সুনীল রায়ের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, মীর আমান ছিলেন তাদেরই একজন।
ছয়.
মীর মোঃ আমান উল্লাহ’র বাড়ির অ লটি ছিল ভারতবর্ষে প্রথম যুগে গড়ে ওঠা একটা শিল্পা ল। ১৯৩০ দশক থেকে এ অ লে ঐতিহ্যবাহী বড় বড় সুতাকল গড়ে ওঠে। ১৯৪০ এর দশকে এ সুতাকল শ্রমিকদের বিক্ষোভ এবং আন্দোলনও হয়। ১৯২৬ সালে গোপাল বসাক ১নং ঢাকেশ্বরী মিলে শ্রমিকদের নিয়ে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টা করেন। এরপর প্রাণগোবিন্দ গুণ, অনিল মুখার্জিসহ জেল থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া বিপ্লবী দলের কয়েকজন যুবক এ অ লে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। এরপর আসেন কমরেড নেপাল নাগ। তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ শ্রমিক নেতা। ১৯৩৯ সাল থেকে প্রবীন শ্রমিক নেতা কমরেড সুনীল রায় চিত্তরঞ্জন কটন মিলে চাকরি নেন এবং শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। তৎকালীন বড় বড় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল শিল্পা লে শ্রমিক আন্দোলনের জন্য সহযোগিতা করতে আসতেন। ১৯৪০ এর দশকে এ সুতাকলগুলোতে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল। ১৯৫১ সালে এ অ লে আদমজী জুট মিল স্থাপন করা হলে সিদ্ধিরগঞ্জ ও গোদনাইল বিশাল শিল্পা লে পরিণত হয়। এ অ লের সাধারণ মানুষের মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বিস্তার লাভ করতে থাকে।
যেহেতু মীর আমানের বাড়িটি ছিল এ অ লে এবং কমরেড সুনীল রায়ের সাথে ছিল সার্বক্ষণিক ওঠাবসা তাই তিনিও শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। শ্রমিক আন্দোলনে মীর আমানের একটা সংক্ষিপ্ত ঘটনা এখানে তুলে ধরছি : মীর আমান যে ২নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলে চাকরি করতেন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলে সেই সরকারি মিলটি ব্যক্তি মালিকানায় দেওয়া হয়। ঢাকেশ্বরী নাম পরিবর্তন করে ‘ইব্রাহিম টেক্সটাইল মিলস’ নাম রাখা হয়। ব্যক্তি মালিকানায় আসার পরপর এই মিলে ব্যাপক হারে শ্রমিক সেটাই চলতে থাকে। শ্রমিকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কমানো হয়। আইনী অধিকারগুলো থেকে শ্রমিকদেরকে বি ত করা হয়। তখন ১৫ দফা দাবির ভিত্তিতে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এটা ছিল ১৯৮৯ সাল। তখন মীর আমান একজন একাউন্টেন্ট হিসেবে এ মিলে চাকরি করতেন। এ প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ঐ সময়ে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবির নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। একদিকে মালিক, প্রশাসন, গুন্ডাবাহিনী ও স্থানীয় মাতবরপ্রধানরা আর অন্যদিকে সাধারণ শ্রমিক। আন্দোলনটি দুই বছর যাবত চলে। এ আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনীর পেছনে মালিক প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে। স্থানীয় এমপি, প্রশাসন, স্থানীয় মাতবরপ্রধান ও  গুন্ডাবাহিনী – সবকিছুই টাকা দিয়ে কেনা ফেলা হয়। একের পর এক নেতাদের উপর মামলা হামলা চলতে থাকে। শ্রমিক নেতাদের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়া হয়। শ্রমিকদের সভা সমাবেশের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করা হতে থাকে। অনেক শ্রমিক হতাহত হয়। দুজন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। আন্দোলন থেকে সরে যাবার শর্তে মীর আমানকেও মালিক পক্ষ থেকে দুই কোটি টাকা অফার দেয়া হয়। মীর আমান এটা প্রত্যাখ্যান করায় তার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা চলতে থাকে। পুলিশ ওয়ারেন্ট নিয়ে নেতাদের বাড়ি বাড়ি হানা দিতে থাকে। ভয়-ভীতি দেখিয়ে মালিকপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত হতে দেয় না। তাদের একটি অংশকে টাকা দিয়ে মালিক কিনে ফেলে। পুলিশের চার্জশিটসহ বিচারকার্যে সর্বক্ষেত্রে কোটি টাকার প্রভাব পড়ায় নিম্ন আদালতে মীর আমানের বিরুদ্ধে ১০ বছরের সশ্রম কারাদÐ রায় দেওয়া হয়। পুলিশ তার বাড়ির মালামাল ক্রোক করে। অন্য নেতাদের বাড়ি বাড়ির পুলিশ থানা দিতে থাকে।
এ রায়ের বিরুদ্ধে ডক্টর কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষসহ স্বনামধন্য আইনজীবীগণ উচ্চ আদালতে আপিল করেন। দুই বছর জেল খাটার পর উচ্চ আদালতে জামিনে মুক্তি নিয়ে বের হন মীর আমান। মামলাটি প্রায় ১৫ বছর ধরে চলে। ইতোমধ্যে মালিক ইব্রাহিম সাহেব মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৫ সালে মামলাটি খারিজ হয়। এ আন্দোলনে এডভোকেট মন্টু ঘোষ ছিলেন শ্রমিক পক্ষের মূল পরামর্শদাতা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটি ও পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দও এই আন্দোলনে সার্বক্ষণিক অংশগ্রহণ করেন।
সাত.
মীর আমান ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতিমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন। মার্কসবাদকে তিনি ভালভাবে বুঝেছিলেন এবং ব্যক্তি জীবনে তার ধারণ করেছিলেন। উন্নত মানবতাবোধের অধিকারী ছিলেন তিনি। মৃত্যুর পরও মানুষের জন্য কিছু করার আছে কিনা তা নিয়ে ভাবতেন। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মরণোত্তর দেহ দান করবেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এনাটমিক বিভাগে তাঁর দেহের কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষকে বাঁচানোর কাজে লাগতে পারে এই ভেবে সিপিবি নেতা হাফিজুল ইসলাম, ন্যাপ নেতা এডভোকেট আওলাদ হোসেন, বন্ধু রোকন উদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক সালাম জুবায়ের ও বন্ধু আশেক আলী মাস্টারকে সাথে নিয়ে এ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। স্ত্রী মাসুদা সুলতানা ও তাঁর ছেলে মেয়েরা এতে সহযোগিতা করেছেন। কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না। কত বড় বুকের পাটা থাকলে মৌলবাদী শক্তির বাঁধা অতিক্রম করে এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব? ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ৯.৩০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন! রাতেই এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সকালে হাজার হাজার মানুষ তাকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছিলেন গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। এই মাঠেই তার জানাজা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন এবং পরিশেষে তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের এনাটমিক বিভাগে হস্তান্তর করা হয়।
আমার জানামতে নারায়ণগঞ্জ জেলায় তিনি প্রথম ব্যক্তি যার মরদেহ মেডিকেল কলেজে দান করা হলো। মরণোত্তর দেহ দান কোন দুর্বল প্রকৃতির মানুষের দ্বারা সম্ভব হয় না। এর জন্য অনেক উন্নত মনের প্রয়োজন হয়। জীবন সাধনায় যারা নিজেকে মানুষের জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকেন একমাত্র তারাই এটা পারেন। বিজ্ঞানমনস্কতা ও আধুনিক চিন্তা চেতনা ছাড়া এটা সম্ভব হয় না। ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মরণোত্তর দেহ দান করেছিলেন। সিপিআইএম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড অনিল বিশ্বাস মরণোত্তর দেহ দান করেছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল নেতা কমরেড আব্দুল মতিন মরণোত্তর দেহ দান করেছিলেন। তাদের সাথে মীর আমানের তুলনা করছি না। তবে নারায়ণগঞ্জের তিনিই প্রথম ব্যক্তি এটা বাস্তবায়িত করে গেলেন। অন্তত এক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জে তিনি অদ্বিতীয় হয়ে থাকবেন।
আট.
কমিউনিস্টরা সৎ গুণাবলীর দিক থেকে সমাজের অন্য দশজন থেকে একটু আলাদা হয়। কিন্তু সেই মানুষদের মধ্যেও মীর আমান উল্লাহ ছিলেন একটু ব্যতিক্রম। তার এমন কিছু ব্যতিক্রম গুণাবলী ছিল যা অন্য দশজনের মধ্যে পাওয়া যায় না। তিনি তার বাবার সাথে আদর্শগত লড়াই করেছেন। পারিবারিক আভিজাত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পার্টির মধ্যে কোন অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করেছেন। নীতির প্রশ্নে তার ঘনিষ্ঠজনদের সাথে আপোষ করেননি। আদর্শগতভাবে মার্কসবাদের প্রশ্নে তিনি ছিলেন পরিষ্কার মনের মানুষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর দলের বড় বড় নেতারা যখন দলত্যাগ করছিলেন তিনি তাতে একটু বিচলিত হননি। তিনি বলতেন, যারা গণফোরামে যাচ্ছেন, রূপান্তরে যাচ্ছেন তারা হারিয়ে যাবেন, কমিউনিস্ট পার্টির কিছু হবে না। তিনি আরো বলতেন যারা মার্কসবাদ ভালোভাবে বোঝেনি তারাই অন্যদিকে যাচ্ছেন।
ইদানিং অনেকে বলার চেষ্টা করেন আমান উল্লাহ শেষ জীবনে কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলেন। অনেকে আরও একটু আগ বাড়িয়ে বলেন, তিনি কমিউনিস্ট পার্টিকে সঠিক মনে করতেন না। এসব কথা যারা বলেন তারা আমান ভাইকে মানুষের কাছে ছোটই করেন। মারা যাবার আগে কয়েক বছর যাবৎ তার সাথে আমার বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি নিয়ে তার মৌলিক কোনো ভিন্নমত ছিল না। বিপ্লবের কর্মকৌশল নিয়ে তার কিছু নিজস্ব মতামত ছিল, যে কোন পার্টি সদস্যের তা থাকতেই পারে। স্থানীয় কিছু সাংগঠনিক প্রশ্নে তার কিছু নিজস্ব মতামত, সমালোচনা ও মান অভিমান ছিল। রাজনীতিতে এগুলো থাকে। তিনি কখনোই কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ রাজনৈতিক লাইন ভুল মনে করেননি। আমার মনে হয়েছে তিনি কখনও কখনও একটু আত্মাভিমানী হয়ে যেতেন। নীতিগত প্রশ্নে খুব শক্ত ছিলেন তো বটেই। আশা করেছিলাম তিনি পার্টিতে ফিরে আসছেন। আমার অনেক আলোচনা হয়েছিল তার সাথে। আমি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করায় তিনি খুশি হয়েছিলেন। যতটুকু আলোচনা হয়েছিল তাতে ধরেই নিয়েছিলাম অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পার্টিতে ফিরে আসছেন। হঠাৎ এভাবে তার মৃত্যুটা না ঘটলে হয়তোবা তাকে পার্টিতে পেয়ে যেতে পারতাম। বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, “আমি তো মার্কসবাদ বিশ্বাস করি, আমি তো আপনাদের সাথেই আছি। যখনই ডাকবেন আমাকে তো পাবেন”।
নয়.
যারা অতীত হয়ে গেছেন, বেঁচে নেই, তাদের কাছ থেকেও আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি। মৃত্যুর পরও এই জগতে তাদের কারো কারো পাহাড় সমান প্রভাব থেকে যায়। একেই বলি আমরা আদর্শ। মানুষের মৃত্যু হলেও তাঁর আদর্শের মৃত্যু হয় না। মীর আমান আল্লাহ আমাদের কাছে তেমনই একজন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে রথীন চক্রবর্তী, আশেক আলী মাস্টার, কমরেড লাল মিয়া, কমরেড খালেক, আলী আজম, ল²ী চক্রবর্তী, মন্টু ঘোষ, মনসুর আলী, সুবিদ আলী, দুলাল সাহা, রোকন উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল মালেকসহ সহকর্মীরা প্রায় সবাই তার নৈতিকতার উচ্চ প্রশংসা করতেন।
মৃত্যুর পর বিভিন্ন সংগঠনের স্মরণসভায় তার প্রতি মানুষের প্রাণঢালা আবেগ ও অনুভ‚তি আমাদের অভিভ‚ত করেছে! এত ভালোবাসা খুব কম মানুষই পায়। তার নৈতিকতা, জীবন দর্শন ও কর্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা নিতেই হবে। মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ইতিহাসের পাতায় নেপাল নাগ, অনিল মুখার্জি, সুনীল রায়, লাল মিয়া, আলী আজম, আব্দুল খালেক, শহীদ কমরেড ইসমাইল হোসেন, মীর আমান উল্লাহরা বিপ্লবী শিক্ষার পাঠ্যসূচি হয়ে থাকবেন। কালের স্রোতে আমরা অনেকেই হয়তো একদিন হারিয়ে যাবো, আমান উল্লাহ বেঁচে থাকবেন দীর্ঘদিন।
দশ.
কমরেড আমান উল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সৎ ও সাহসী। চলাফেরা, কথাবার্তায় ছিলেন খুব সাধারণ। সহজেই মানুষকে কাছে টানতে পারতেন। শ্রমজীবী মানুষ বিপদে আপদে পরামর্শ ও মতামতের জন্যে তার কাছে আসতেন। তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে যেতেন এবং আচরণেই বুঝতেন মীর আমান সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
তিনি কখনও সহকর্মীদের সাথে মিথ্যা কথা বলতেন না। ধনী পরিবারে জন্ম নিয়েও অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। শ্রমজীবী মানুষকে তিনি বেশি বেশি সম্মান করতেন। বামপন্থী অনেক বড় বড় নেতা অফিস পিয়ন, রিক্সাওয়ালা বা বাসার কাজের মানুষদের মর্যাদা দিতে জানেন না। আবার কখনো কখনো প্রভাবশালী কাউকে বেশি বেশি খাতির দেখান। এক্ষেত্রে মীর আমান ছিলেন একেবারে আলাদা। নেতাদের অনেকে পোস্টারে নাম থাকা, মে  ওঠা, পত্রিকায় ছবি আসা ও মিছিলের সামনে দাঁড়ানোর জন্য অনৈতিক প্রতিযোগিতা করেন। এমন কোন অনৈতিকতার বিন্দুমাত্র উপাদান তাঁর মধ্যে ছিল না। অনেকে অসৎ পন্থায় পদ-পদবি ও নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা করেন, নেতৃত্ব দখলের জন্য দলের মধ্যে উপদল তৈরি করেন। দলের মধ্যে ঐক্য নষ্ট করেন। দলের চেয়ে নিজের নাম প্রচার ও ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। এ ধরনের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি তাঁর মধ্যে কখনো পাওয়া যায় নি। নেতাদের অনেকে নিজেকে বেশি জ্ঞানী, বেশি যোগ্য, বেশি অবদান রেখেছেন ইত্যাদি বলে দলের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন। তিনি কখনোই তা করেননি।
নেতৃত্বের একটা অংশ পারিবারিক ঐতিহ্য ও অর্থবিত্তের জোরে দলের মধ্যে ব্যক্তিগত বলয় গড়ে তোলা ও ব্যক্তিকে দলের উর্ধ্বে উত্থাপন করার চেষ্টা করেন। মীর আমান উল্লাহ ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তা কখনো করেননি। শিল্প-সাহিত্য, দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে তার পড়াশোনা, জানাবোঝা ছিল অনেক কিন্তু কখনোই নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করেননি। দর্শন ও বিজ্ঞান চেতনার বিষয়ে তিনি একেবারেই পরিষ্কার ছিলেন। মার্কসবাদকেই তিনি জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জীবনাচারের মধ্য দিয়ে তার প্রমানও দিয়েছেন। তিনি যে মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন, তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও পরিবারের সকলকে সেই আদর্শে নিয়ে আসার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেছেন। তিনি একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অনেকে যেমন পদ-পদবিতে থাকার সুযোগ নিয়ে আমলাতান্ত্রিক আচরণ ও হুকুমদারী করেন এবং নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করেন; সেক্ষেত্রে কমরেড আমান উল্লাহ ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম।
অন্যের মতামতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কেবল নিজের চিন্তা সঠিক এমন গোড়ামিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। গণতন্ত্র, সমমর্যাদা ও যৌথ নেতৃত্বে আস্থা রাখেতেন। অনেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে ব্যবহার করেছেন নেতা হবার জন্য, ব্যক্তিগত মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য, নিজেকে প্রদর্শন করার জন্য। অনেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে থেকেও সরকার, রাষ্ট্র, প্রশাসন ও বুর্জোয়া জগতের সাথে গোপন যোগাযোগ রেখেছেন। অনেকে সুযোগ বুঝে সরকারি দলে যোগদানও করেছেন। আদর্শ ঠিক না থাকলে তার কমিউনিস্ট পার্টি করার কোন প্রয়োজন নেই, তাতে পার্টির ক্ষতি হয়। নেতাদের আচরণের মধ্যেই ফুটে ওঠে তাঁর চরিত্র। আমান উল্লাহর প্রতিদিনের আচরণের মধ্যে তার আদর্শ প্রতিফলিত হোত। মার্কসবাদ ছিল তাঁর জীবনদর্শন।
এগার.
সাধারণত যে সকল গুণাবলী একজন কমিউনিস্টের থাকা উচিত মীর আমান উল্লাহর মধ্যে তার সবটুকু ছিল। একজন কমিউনিস্টকে একই সাথে তিন স্তরের সংগ্রাম করতে হয়। ১. নিজের মধ্যে সংগ্রাম, ২. দলের মধ্যে সংগ্রাম, ৩. রাজপথের সংগ্রাম।
আমান উল্লাহ যে নিজের মধ্যে সংগ্রাম করতে পেরেছিলেন তার অনেক প্রমাণ রেখেছেন। ১৯৬৬ সালে পিতামহ ও বংশের বিপরীতে গিয়ে গোদনাইল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শহীদ মিনার নির্মাণ করেছিলেন। সেটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান, পরিবারের বিপরীতে গিয়ে একটি সাধারণ পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছিল। আমাদের অনেক কমরেড আছেন ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রশ্নে এ সকল ক্ষেত্রে এসে হেরে যান। আমান উল্লাহ হারেন নি। আমান উল্লাহ দলের মধ্যে সংগ্রামের প্রশ্নে যে আপসহীন ছিলেন তার অনেক প্রমাণ আছে। রথীন চক্রবর্তীর লেখা থেকে দেখা যায় তিনি মোট তিনবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছেন। রথীন চক্রবর্তীর বক্তব্য অনুযায়ী আদর্শগত অবস্থান থেকেই তিনি এগুলো করেছেন। দলের মধ্যে নিকটতম বন্ধুদেরও খাতির করে কথা বলতেন না। কোন অন্যায় মনে হলে তার প্রতিবাদ করতেন। অবশ্য কখনো কখনো কিছু ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে হয়তো।
রাজপথের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তার সততা ও সাহসের প্রমান আছে ভুরি ভুরি। জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ইব্রাহিম টেক্সটাইল মিলের আন্দোলন তার জীবনে উদাহরণ হয়ে আছে। তারপরও বলতে হয় মানুষ দেবতা নয়, দোষেগুনে মানুষ। তার কোন ত্রæটি থাকতেই পারে না এমন তো নয়।
তিনি বড় কোনো নেতা ছিলেন না কিন্তু একজন কমিউনিস্টের যে সততা, নৈতিকতা থাকা উচিত তার সর্বোচ্চটা তিনি অর্জন করেছিলেন। শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিষ্কার বুঝেছিলেন। কারা শোষণ করে, কারা শোষিত হয়, এসব প্রশ্নে তিনি ছিলেন পরিষ্কার। তিনি বলতেন, “এই যে উন্নয়ন, এই যে আধুনিক সভ্যতা এর মূলে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম। যারা তৈরি করে তারা থাকে বি ত, যারা তৈরি করে না তারাই মালিক। আমাদের সমাজ অন্যায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্যবস্থা উচ্ছেদ করাই আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য। এর নাম বিপ্লব। একারণেই কমিউনিস্ট পার্টি প্রয়োজন”।
শ্রেণিসংগ্রাম ও শোষিত মানুষের মুক্তির প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল। বিপ্লব ছিল তার স্বপ্ন। এধরনের আদর্শবান কমরেড আমাদের বেশি বেশি সংখ্যায় প্রয়োজন। অত্যন্ত দুঃখজনক, জীবনের শেষ সময় এসে তিনি পার্টিতে ছিলেননা। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেও এই রাজনীতিতে এসে সারাজীবন সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করেছেন। দলের জন্য, আদর্শের জন্য এত যার ত্যাগ, জীবনের শেষ মুহূর্তে তাকে দলে না পাওয়ার ব্যথা আমাদের থেকে যাবে। শৈশব থেকে শুরু করে অন্তত ৫০ বছর এই দলের সঙ্গে ছিলেন। সাংগঠনিকভাবে উল্লেখযোগ্য কোন ভুলত্রæটি তার ছিল না। পার্টিতে থাকলে মৃত্যুকালে হয়তো জেলার কোন বড় নেতৃত্বেই থাকতেন। নারায়ণগঞ্জ জেলায় আরো অসংখ্য বিপ্লবী কমরেড ছিলেন যারা নিকট অতীতে গত হয়েছেন। নৈতিকতার দিক থেকে তারা প্রত্যেকে এক একটা উদাহরন। সুনীল রায়, হেনা দাস, লাল মিয়া, ইসমাইল হোসেন, মোমিনুল হক, আলী আজম, আব্দুল খালেক, শহিদ তাজুল, কালাচাঁদ, সিরাজুল হক, আঃ রউফ মৃর্ধা, মুনসুর আলী, শুবেদ আলী, প্রাণগোবিন্দো গুণ, কমরেড সোবহান – এমন আরও অনেকের নাম বলা যাবে। মীর আমান উল্লাহ এদেরই একজন। বিপ্লবী আন্দোলনে এরা প্রত্যেকেই এক একটা মডেল। নারায়ণগঞ্জ জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে তো বটেই। এরা আমাদের সামনে দীর্ঘকাল উদাহরণ হিসেবে থাকবেন। আমরা হাঁটতে থাকবো তাদের দেখানো পথে বেয়ে।
লেখক : বিমল কান্তি দাস, সম্পাদক মন্ডলী সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটিং নারায়ণগঞ্জ জেলা

নার্সারীতে সফলতা পেয়ে নার্সারী নুরুল ইসলাম সাত বার অর্জন করেছেন জেলা প্রশাসনের সম্মাননা পদক

ফেইসবুকে আমরা

এ সম্পর্কিত আরো খবর...

error: Content is protected !!
error: Content is protected !!