শিরোনাম
বাঁচাতে হবে শীতলক্ষ্যা এবং তার পাড়ের প্রাণ প্রকৃতিকে – বিলকিস ঝর্ণা
বিলকিস ঝর্ণা: নদীর নাম শীতলক্ষ্যা। যার নাম শুনলেই তার শীতল স্রোত ছবির মতো ভেসে ওঠে চোখের কিনারায়। একসময় এই নদীর স্বচ্ছ গভীর পানিতে নৌকায় ভেসে ভেসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত কত শত মানুষের। মন খারাপ আর অশান্ত মনের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল শীতলক্ষ্যা। বন্দর ঘাটের কোলাহল ছেড়ে কতদিন নৌকার মাঝি কত শত জনকে নিয়ে গেছে দূর থেকে দূরে। যেখানে জলের সাথে মিলে গেছে ঘাস, ফসলের ক্ষেত। কত বেনামি চোখের জল শীতলক্ষ্যায় ভাসতে দিয়ে আকুতি জানিয়েছি নদীর কাছে। বলেছি শোধরে দাও হে প্রিয় নদী, আমার যত পরিতাপ। আমার আর কোথাও যাবার নেই –কিচ্ছু করার নেই।
এই নদীর তীরেই একদিন গড়ে উঠেছিলো এক নগরী। ছেলেবেলায় ক্লাসে প্রিয় শিক্ষকের থেকে শুনেছিলাম। নারায়ণগঞ্জকে প্রাচ্যের ডান্ডি বলা হয়। আব্বার কাছ থেকে শুনতাম টাঙ্গাইল আমাদের বাড়ির সামনের ঘাট থেকে কত নদীপথ পার হয়ে বড় বড় পাটের নাও নিয়ে আসতেন নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আন্তঃনদীবন্দর। এই শহরে আমার প্রথম দিনের স্মৃতি শীতলক্ষ্যা নদী। ২৯ বছরের পুরনো সেসব গল্প। তারপর মস্ত মস্ত জাহাজের ভেঁপুর আকাশ বিদীর্ণ শব্দ মিলিয়ে গেছে অন্য কোলাহলে। সভ্যতার শিল্পোন্নয়ন আর তার কারখানার দূষণে একাকার শীতলক্ষ্যা। শীতলক্ষ্যা এক মৃত নদীর নাম। শীতলক্ষ্যা ব্রহ্মপুত্র নদের একটি উপনদী।
গাজীপুর জেলার টোক নামক স্থানে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। এই ব্রহ্মপুত্রের দুটি ধারা। তার একটি বানার নামে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বাহিত হয়ে শীতলক্ষ্যা নাম ধারণ করেছে। প্রবাহিত হয়েছে বৃহত্তর ঢাকা জেলার পূর্ব পাশ দিয়ে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১১০ কিমি, প্রস্থ নারায়ণগঞ্জের কাছে ৩০০ মিটার, কিন্তু উপরের দিকে আস্তে আস্তে কমে গিয়ে হয়েছে প্রায় ১০০ মিটার। ডেমরায় সর্বোচ্চ পানি প্রবাহ ২,৬০০ কিউসেক। নদীটি নাব্য এবং সারা বছরই নৌ চলাচলের উপযোগী। গভীরতার কারণে শীতলক্ষ্যার ভাঙন প্রবণতা কম। কিন্তু এ নদীর দুপাশে গড়ে উঠেছে নদী বিধ্বংসী বৃহৎ বৃহৎ শিল্পকারখানা। যা নদী দূষণ- নদী সংকোচন -বায়ু দূষণ -শব্দ দূষণের ভাণ্ডার। অথচ কথিত আছে স্বচ্ছ সলিলা এই স্রোতস্বিনীর পানি অতি নির্মল ও সুস্বাদু হওয়ায় শীতলক্ষ্যা নামে অভিহিত। শোনা যায় এই জনপদের মানুষের পানের উপযোগী ছিলো এই নদীর জল। আর জাহাজে জাহাজে যেত ‘পিওর শীতলক্ষ্যা ওয়াটার’এর চালান। জাতীয় তথ্য বাতায়নে এমন তথ্যও পাওয়া যায় যে, ইংল্যান্ডের কোম্পানিগুলোর ওষুধ তৈরির জন্য ব্যবহার হতো এই নদীর স্বচ্ছ জল। ছিলো অজস্র ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। থেকে থেকে ভেসে উঠতো শুশুক। শীত মৌসুমে নদীর পানি কমে আসলে বালুময় নদীপারে হেঁটে বেড়াতো মৎস্যজীবী পাখিরা।
এই শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের সম্পর্ক নিয়ে কথিত আছে কত পৌরাণিক কাহিনি। শীতলক্ষ্যা – ব্রহ্মপুত্র – পরশুরাম আর বুড়িগঙ্গা নদীর সেই আখ্যানগুলোতে এই রকম শোনা যায় ‘মহামুণি জমদগ্নির আদেশে পুত্র পরশুরাম কুঠারের আঘাতে বধ্ করেন নিজের মাকে। মাতৃহত্যার পাপে তাঁর হাতেই আটকে যায় সেই কুঠার। শত চেষ্টাতেও তা ছাড়াতে না পেরে হতাশ পরশুরাম বেরিয়ে পড়েন ব্রহ্মপুত্রের খোঁজে। একসময় পর্বতের নিম্নদেশে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রের সন্ধান পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার হাত থেকে ছুটে যায় কুঠার। তারপর পরশুরাম মহাপবিত্র সেই হ্রদের পানি মর্ত্যে পৌঁছে দেওয়ার মানসে কুঠারটি লাঙলাবদ্ধ করেন। চালিত করেন পর্বতের মধ্য দিয়ে। সেই লাঙল পর্বত ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। ব্রহ্মপুত্রকে চালিত করে সমভূমিতে। লাঙলের গমন পথে তৈরি হয় নদী। লাঙল এসে যেখানে আটকে যায়, তার নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। যেখানে লাঙল থেমে যায়, তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন চঞ্চলা, যৌবনগর্বিতা, অনিন্দ্যসুন্দরী শীতলক্ষ্যা। তাঁকে দেখতে দুকূল ভেঙে ধাবিত হন ব্রহ্মপুত্র। প্রবল পরাক্রমশালী ব্রহ্মপুত্রকে দেখে ভীত শীতলক্ষ্যা নিজের রূপ লুকিয়ে বৃদ্ধার বেশ ধারণ করেন। নিজেকে উপস্থাপন করেন বুড়িগঙ্গারূপে। ব্রহ্মপুত্র তাকে বলেন, ‘মাতঃ, শীতলক্ষ্যা কত দূরে?’ জবাবে বৃদ্ধাবেশী বলেন, ‘আমারই নাম শীতলক্ষ্যা। আমি আপনার ভীষণ রবে ভীত হয়ে বৃদ্ধার বেশ ধারণ করেছি।’ এ কথা শুনে দ্রুত ধাবিত হয়ে শীতলক্ষ্যার অবগুণ্ঠন ছিঁড়ে ফেলেন ব্রহ্মপুত্র। তাদের মিলন হয়। এক স্রোতে মিশে যায় দুই নদী।’ এমনি কতশত আখ্যানে মিশে আছে আমাদের এই নদীর দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু নদীমাতৃক এদেশের নদীর দুরবস্থার কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট কারণে বেশির ভাগ নদী হারিয়েছে নাব্য। বন্ধ হয়ে গেছে নদীর স্রোত। জল শূন্য হয়ে ফসলের মাঠে মিলে গেছে নদীর কোথাও কোথাও। তাকে নদী বলে আর চেনবার উপায় নেই। নদী দখল, নদী ভড়াট, এবং বর্জ্য নিষ্কাশনের ফলে বাংলাদেশের নদী সম্পদ আজ হুমকির মুখে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিল্পের উন্নয়নে নদ -নদীর অনেকটাই আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। ছোট ছোট নদীর অনেকগুলোরই আর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। বড় নদীগুলোর স্রোত ক্ষীণ হতে হতে পরিণত হয়েছে সরু খালে । বছরের অধিকাংশ সময়ে সেসব নদী থাকে অনাব্য। শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি নদীকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বাঁচতে দিতে হবে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় প্রকাশ হয়েছে গত ৫০ বছরে প্রায় ৫৫০ নদী মরে গেছে, এসব সোঁতা নদী দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। নদী মাওেতৃত এই দেশে নদীর উন্নয়ন চাড়া কোনো উন্নয়ন দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করবে না-করার কথা নয়। খাদ্য নিরাপত্তা, গণপরিবহন সংকট, ফসলের ক্ষেতে পানি দেয়ায় নদীর বিকল্প নেই সেটা করাও সম্ভব। প্রয়োজন নদী খনন প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর নাব্য বাড়ানো।
পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে বড় বড় নদ নদীকে কেন্দ্র করে। নদী জীবিকার উৎস। অথচ সভ্যতাই আজ আমাদের নদী প্রকৃতি ধ্বংসের মূল উপকরণ। তাই শীতলক্ষ্যা আজ বিষের নদী। শীতলক্ষ্যার জলকে আর জল বলা চলে না। শীতলক্ষ্যার শরীরে নেই কোনও প্রাণের স্পন্দন। শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আর শ্বাস নেওয়া যায়না। শীতলক্ষ্যার রক্তের পচে যাওয়া দুর্গন্ধ ভেসে বেড়ায় নগরের বাতাসে।
সভ্যতার কল নড়ে মানুষের বিবেকে। তাইতো নগর সৃষ্টির ইস্যু আজ আমাদের হাতে ধ্বংস হয়। নদী হয় বর্জ্য নিষ্কাশনের আধার। প্রাণের অস্তিত্ব তাই সংকটাপন্ন। সংকটাপন্ন আমাদের প্রাকৃতিক পরি
সংকটাপন্ন আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
নদীকে বাঁচানো আজ আমাদের প্রাণের দায়। নদীকে বাঁচাতে হবে। বাঁচতে দিতে হবে। শহরের কলকারখানার এবং নগরীর বর্জ্য নিষ্কাশনের বিকল্প ব্যবস্থায় পরিত্রাণ পেতে পারে নদী। উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রের। তরল বর্জ্য নির্গমনকারী সকল প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা আছে কিনা সেই দিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে কর্তৃপক্ষের। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের শত শত ডায়িং ফ্যাক্টরির অপরিশোধিত কেমিক্যাল যুক্ত পানি ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে শীতলক্ষ্যাকে। যার প্রভাবে এক সময়কার মৎস্য সম্পদে ভরপুর শীতলক্ষ্যা আজ প্রাণী শূন্য। শীতলক্ষ্যায় আজ আর কোনো মাছ নেই। নেই মৎস্য জাতীয় কোনো প্রাণীও। নব উদ্যমে নিয়ম নীতিবহির্ভূতভাবে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট কারখানা। যার প্রভাবে কেবল শীতলক্ষ্যার পানিই নয়, দূষণে ভারি হয়ে উঠছে আশেপাশের বাতাসও। পরিবেশ এবং নদী রক্ষায় এসব কারখানা নির্মাণে নদী কমিশন আইনের শক্ত ভ‚মিকা রাখতে হবে। দরকার যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগের।
তবে আইনে যা কিছুই বলা হোক না কেন, নদ-নদীর অবৈধ দখল, দূষণ, নাব্যতা হ্রাস, পানি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জৈববৈচিত্র্য বিঘ্নিত বা সংকটাপন্ন বলে মনে করলে ওই এলাকাতে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করতে পারবে কমিশন। এক্ষেত্রে শীতলক্ষ্যা সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষিত হওয়ার অবস্থাদৃষ্ট। শীতলক্ষ্যাকে রক্ষা করবার সমূদয় বিহিত ব্যবস্থা নেয়া আশু প্রয়োজন। এবং শীতলক্ষ্যা সহ দেশের সকল নদ -নদীকে বাঁচানোর প্রকল্প সরকারের হাতে নেয়া এখন এদেশের বিবেকবান মানুষের দাবি। নদী বাঁচাতে এখন যথাযথ আইনের প্রণয়ন এবং প্রয়োগ জরুরি।
নদী জীবন ও জীবিকার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ স্রোতধারা ফিরলে তবেই বাঁচবে নদী। বাঁচবে শীতলক্ষ্যা পারের প্রাণ প্রকৃতি ও মানুষ। আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সেই উদ্যোগের অপেক্ষায়।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট