সোজা পথে চলতে পারে না অটোরিকশা
রাজশাহী নগরীর ব্যস্ততম এলাকা রেলগেটে হট্টগোল। এক বাসচালক এবং এক সিএনজি অটোরিকশা চালকের কথা কাটাকাটি চলছে। বাস রাখার জায়গায় অটোরিকশা রাখা হয়েছে বলে দাবি বাস চালকের। আর অটোরিকশা চালকের দাবি, বাসের জায়গায় অটোরিকশা নয় বরং অটোরিকশা রাখার বড় অংশই দখল করেছে বাস। এখন কে যাত্রী নেবে তাই নিয়ে হট্টগোল।মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর) সকালের মতো এ দৃশ্য প্রতিদিনই চোখে পড়ে রেলগেটে। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের এই এলাকার একপাশে সারি সারি রাখা থাকে সিএনজি অটোরিকশা। দাঁড়িয়ে থাকে বাসও। এখান থেকে রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলোতে যাত্রী নিয়ে যায় অটোরিকশা। কিন্তু যাত্রী তুলতে বাধার মুখে পড়তে হয় তাদের। যাত্রী নিতে যাত্রার শুরুতেই যে বাধা তা যাত্রাপথের আরও নানা জায়গায় আসে বলে অভিযোগ অটোরিকশার চালকদের। এই বাধার কারণে সোজা পথে না গিয়ে ঘুরে ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় তাদের।সিএনজি অটোরিকশার চালকেরা জানান, রেলগেট থেকে রাজশাহীর ভবানীগঞ্জ, নওহাটা, মোহনপুর, বাগমারা, কেশরহাটের দিকে তারা যাত্রী নিয়ে যান। নওগাঁ, জয়পুরহাট-পাঁচবিবিও যান তারা। এসব রুটে বাস চালকরা নির্বিঘ্নে যাতাযাত করতে পারলেও অটোরিকশার চালকেরা বার বার নানা হয়রানির মুখে পড়েন। তাদের অভিযোগ, বাসের লোকজনের কারণে তারা মহাসড়কে উঠতে পারেন না। বিভিন্ন স্থানে অটোরিকশা থামিয়ে তাদের চলাচলে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাই ঘুরে ঘুরে গন্তব্য পোঁছাতে হচ্ছে তাদের। এতে সময় ও জ্বালানির অপচয় হচ্ছে।রাজশাহী জেলা মিশুক মালিক সমিতির তথ্য মতে, রাজশাহীতে প্রায় ৭০০টির এর মতো সিএনজি অটোরিকশা আছে। তবে সংগঠনের নিবন্ধিত অটোরিকশার সংখ্যা ৫০০ এর মতো। বাকি প্রায় ২০০টি অটেরিকশা সংগঠনের আওতায় নিবন্ধনের জন্য প্রক্রিয়াধীন। বাসের চালক ও হেলপারদের চাপে থাকেন তারা। এ কারণে দুই পক্ষের মধ্যে সব সময়ই একটা উত্তেজনা বিরাজ করে।সিএনজি অটোরিকশা চালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শহরের রেলগেট থেকে তানোর উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু এই রোডে সিএনজি অটোরিকশা চালকরা সরাসরি যেতে পারেন না। তানোরে যেতে বাগদানি নামের একটি জায়গাতে তাদের আটকানো হয়। বাগদানিতে যাওয়ার পরেই তাদের তানোর প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ফলে ১৪ কিলোমিটার ঘুরে গ্রামের ভেতর দিয়ে ঘুরে তানোরে পোঁছাতে হয়। এমনকি সিএনজি অটোরিকশা চালকরা সরাসরি রাজশাহী প্রবেশও করতে পারেন না। তাদের মোহনপুর উপজেলা ঘুরে শহরে আসতে হয়।তানোর উপজেলার মতো গোদাগাড়ী উপজেলায় প্রবেশ করতেও সমস্যার মুখোমুখি হন সিএনজি অটোরিকশার চালকরা। গোদাগাড়ীতে প্রবেশ করতে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা মোড়ে বাধা দেওয়া হয়। যার কারণে কাশিয়াডাঙ্গা মোড় থেকে ভেতরের রাস্তা ব্যবহার করে তাদের গোদাগাড়ীতে পৌঁছাতে হয়। একইভাবে বাগমারা উপজেলায় প্রবেশ করতেও বাধার মুখে পড়েন সিএনজি চালকরা। গাঙ্গোপাড়া নামক একটি স্থানে পথ আটকে দেওয়া হয় সিএনজি অটোরিকশা। এমনকি বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌরসভায় ঢুকতেও তাদের বাধা দেওয়া হয়। রাজশাহী থেকে ভবানীগঞ্জ পৌরসভার দূরত্ব প্রায় ৪১ কিলোমিটার। এই পৌরসভায় প্রবেশ করতে গেলে মচমইল নামের একটি স্থানে সিএনজি অটোরিকশা পথ আটকান বাসের লোকজন।নওগাঁ জেলার মান্দা ফেরিঘাট যেতেও বাধার মুখে পড়েন সিএনজি অটোরিকশার চালকরা। রাজশাহী থেকে মান্দা উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৫২ কিলোমিটার। সেখানে যেতে কামারপাড়া স্থানে বাধা দেওয়া হয়। তাই যাত্রীদের নিয়ে ২৪ কিলোমিটার বাড়তি ঘুরে মান্দায় প্রবেশ করে অটেরিকশা। মান্দার আগে মোহনপুরের কেশরহাটে যেতে চাইলেও কামারপাড়ায় আটকানো হয় তাদের।সিএনজি অটোরিকশার চালকেরা জানান, মান্দা ফেরিঘাট থেকে দুপুর ১টার মধ্যে রাজশাহীতে সিএনজি ঢুকতে পারে। তবে বেলা ১টার পরে কোন সিএনজি ফেরিঘাটের উদ্দেশে যেতে পারে না। যখন যেখানে খুশি সেখানেই বাসের লোকজন অটোরিকশা থামিয়ে দেয় বলে অভিযোগ তাদের।সিএনজি অটোরিকশার চালক শাহীন কাওসার বলেন, ‘রাজশাহী থেকে বাসে যেমন লোক যায় তার চেয়েও বেশি লোক সিএনজিতে যায়। প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকার রোগীরা সিএনজিতে করে শহরের হাসপাতালে আসে। একজন রোগী কেশরহাট থেকে ৫০০ টাকায় শহরে আসে। অ্যাম্বুলেন্স কিংবা মাইক্রোবাসে এলে তিন হাজার টাকার উপরে ভাড়া লাগতো। তাই সিএনজির চাহিদা অনেক। কিন্তু আমাদের বাসের লোকজন চলতে দেয় না। বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড থাকার জন্য অনেক ঘুরে যেতে হয়। এতে আমাদের খরচ বেশি পড়ে, কিন্তু ভাড়া বেশি নিতে পারি না।’একই কথা বললেন আরেক সিএনজি অটোরিকশার চালক নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তেলের লিটার ১৩০ টাকা, গ্যাস ৪২ টাকা লিটার, এলপিজি গ্যাস ৫২ টাকা লিটার। এক লিটার তেলে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার গাড়ি চলে। ঘুরে যাবার কারণে আমাদের তেল ও গ্যাসের খরচ বেশি পড়ে যায়। মহাজনকে ৫০০ টাকা দিয়ে অনেক সময় হাতে তেমন টাকাই থাকে না।’রাস্তায় রাস্তায় বাধা পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন রাজশাহী জেলা মিশুক অটোরিকশা ও অটোটেম্পু চালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোথাও ব্যারিকেড দেওয়া হয়নি। এই ব্যারিকেডগুলো দিয়েছে বাস মালিক সমিতির লোকজনেরা। প্রায়ই এই নিয়ে বাস ও সিএনজি চালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়।’জেলা মিশুক মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুস সাত্তার মিলু বলেন, ‘চালকেরা এ ধরনের বাধা পাওয়ার কথা এসে জানান। আমরা এই সমস্যার কথা জানি। আমরা সমস্যার সমাধান চাই।’জেলা বাস মালিক সমিতি সাধারণ সম্পাদক মতিউল হক টিটো বলেন, ‘আসলে রাস্তার কোথাও কোন বারিকেড নেই, তবে আমাদের বিভিন্ন স্টপেজ আছে। সিএনজিগুলো যেখান সেখান থেকে যাত্রী তোলে। এতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বাড়ে। তাই এই স্টপেজ থেকে অনেক সময় তাদের সতর্ক করা হয়। যাতে যেখান সেখান থেকে যাত্রী তুলতে না পারে।’তিনি আরও বলেন, ‘যে ছোট যানবাহনগুলোর লাইসেন্স নেই, সেগুলো যেন মহাসড়কে চলতে না পারে তার জন্য প্রশাসন এবং বিআরটিএ কাছে আবেদন করেছি। মিশুক মালিক সমিতিকে বলেছি আমরা যেমন একটি সিস্টেমে চলি আপনারাও একটি সিস্টেমের মধ্যে চলেন। আপনাদের কতগুলো গাড়ি কীভাবে চলে তার একটি তালিকা দেন। একটি রোডে হাই স্পিডে গাড়ি চলে, আবার লো স্পিডেও চলে। অনেক সময় স্পিডের সম্বন্বয় না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে। তাই আমরা চাই, সিএনজিগুলো যেন মহাসড়কে না আসে।’