মেঘালয়ের পাদদেশে লাল শাপলার রক্তিম হাতছানি
‘তুমি সুতোয় বেঁধেছো শাপলার ফুল, নাকি তোমার মন’ সুবীর নন্দী ও অনুপমা মুক্তির কণ্ঠে গাওয়া এই গানই যেন চিত্রায়িত হয়েছে সিলেটের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের ঝর্ণা বেষ্টিত ডিবির হাওরে। শীতের আগমনী বার্তা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরী করেছে জৈন্তাপুরের এই হাওরে। পুরো হাওর জুড়ে এখন লাল শাপলার সমারোহ। ভারতের মেঘালয় পাহাড় ঘেষা সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জৈন্তাপুর। ইতিহাস ঐতিহ্য আর পর্যটনে সমৃদ্ধ জৈন্তাপুরে শুধু লাল শাপলার হওর নয়, রয়েছে বাংলাদেশের নীলনদ খ্যাত পর্যটনকেন্দ্র লালাখাল। তবে শীতের আগমনী বার্তা এলেই লাল শাপলার বিলে ভিড় বাড়ে পর্যটকদের। এই বিলে শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর দূরান্ত থেকে আসেন পর্যটকরা।পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জৈন্তা রাজ্য শাসন করেছেন খাসিয়া রানী জৈন্তেশ্বরী দেবী। এটি ছিল প্রমীলা (নারী) শাসিত রাজ্য। পরাক্রমশালী মোগল ও ইংরেজরা কখনো জৈন্তিয়া জয় করতে পারেনি। আজও সিলেট অঞ্চলে এ রাজ্য সম্পর্কে নানা গল্প শোনা যায়, যা রূপকথাকেও হার মানায়। জৈন্তিয়া রাজা বিজয় সিংহের সমাধিস্থল রয়েছে লাল শাপলার বিলে। এই বিল লাগোয়া মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সাব সেক্টর মেঘালয়ের মুক্তাপুর। কেবল সৌন্দর্য নয়, সিলেটের জৈন্তাপুরের লাল শাপলার বিল প্রাগৈতিহাসিক ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।লাল শাপলা হওরের অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়ের পাদদেশ। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট চারটি বিল নিয়ে গঠিত ডিবির হাওর। স্থানীয়রা জানান, ডিবি বিল, ইয়াম বিল, হরফকাট বিল ও কেন্দ্রী বিলের ৯০০ একর এলাকা জুড়েই ডিবির হাওর।আর এই হাওরের জুড়েই লাল শাপলার ‘রাজ্য।’স্থানীয়দের মতে, জৈন্তা রাজ্যের রাজা রাম সিংহের মামা বিজয় সিংহকে এই হাওরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নৌকা ডুবিয়ে মারা হয়েছিলো। সেই স্মৃতিতেই নির্মিত ২০০ বছরের পুরাতন একটি মন্দিরও রয়েছে লাল শাপলার হাওরে। সরেজমিনে দেখা গেছে, জৈন্তাপুর হয়ে জাফলং ঘুরতে যাওয়ার সময় পর্যটকরা লাল শাপলার হাওরে ঢু মারেন। অনেকে কেবল লাল শাপলার সৌন্দর্য দেখতে আসেন। দিন কাটিয়ে দেন এখানেই।এছাড়া প্রতিবছর অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে এই হাওরে। তার মধ্যে বালিহাঁস, পাতি সরালি, পানকৌড়ী, নীল কণ্ঠি, সাদাবক, জল ময়ূরসহ অসংখ্য প্রজাতীর পাখির দেখা মেলে এখানে। ভোরবেলা দূর থেকে দেখলে মনে হবে প্রকৃতি লাল গালিচা বিছিয়ে পর্যটকদের বরণ করতে হানছানি দিয়ে ডাকছে। লাল শাপলা হাওরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে হলে আসতে হবে ভোরে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত সতেজ থাকে শাপলাগুলো। লতা—পাতা ও গুল্মে ভরা হাওরের পানিতে ভেসে থাকা লাখ লাখ শাপলার মাঝে গেলে যে কেউ অন্য ভুবনে হারিয়ে যাবেন। জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম বলেন, শাপলা বিল বেড়িয়ে যাওয়ার এখনই সময়। এই বিল সংরক্ষণে উপজেলা প্রশাসন কমিটি করে দিয়েছে। প্রকৃতিকে রক্ষা করে পর্যটনের বিকাশ নিয়ে চিন্তার করছে উপজেলা প্রশাসন। যেভাবে যেতে হয় লাল শাপলার বিলে: সিলেট থেকে সিলেট-তামাবিল সড়ক পথে বাস, লেগুনা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা অথবা প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসে করে শাপলা হাওরে যাওয়া যায়। সিলেট থেকে জৈন্তাপুর যেতে গেটলক বাসে ভাড়া পরবে ৯৫টাকা।জৈন্তাপুর উপজেলা সদর ছেড়ে তামাবিল স্থল বন্দরে যাওয়ার আগেই সড়কের ডান পাশে দেখতে পাবেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ডিবির হাওর বিশেষ ক্যাম্পের সাইনে বোর্ড। ক্যাম্পের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তায় প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার পথ পেরোলেই চোখে পড়বে শাপলা হাওর। নৌকায় লাল শাপলার হাওর ঘুরতে ভাড়া নেবে ৪০০ টাকা।