নারায়ণগঞ্জ  বৃহস্পতিবার | ২রা অক্টোবর, ২০২৫ | ১৭ই আশ্বিন, ১৪৩২ শরৎকাল | ৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৭

শিরোনাম
  |   আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না আড়াইহাজার থানা ওসি   |   মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে গনপিটুনিতে ডাকাত নিহত   |   বিভিন্ন পূজা মন্ডপ পরিদর্শন করে আর্থিক অনুদান দিলেন জাকির খান   |   মহাঅষ্টমীতে শঙ্খ, ঘণ্টা আর উলু ধ্বনির মধ্য দিয়ে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত   |   দুই গ্রুপের টেঁটাযুদ্ধ উভয় পক্ষের ১২জন আহত   |   এই দেশে ধর্ম দিয়ে কাউকে বিচার করা হবে না – আবদুল্লাহ আল আমিন   |   বিএনপিতে যোগদানে সর্বস্তরের শুভেচ্ছায় সিক্ত মাসুদুজ্জামান মাসুদ   |   দেশের মানুষ ওয়ানম্যান- ওয়ান ভোট পদ্ধতিতে চায় – ড. আবদুল মঈন খান   |   লায়ন্স ক্লাব অব নারায়ণগঞ্জ এর  নতুন কমিটির অভ্যর্থনা চার্টার নাইট   |   বিএনপি’র ৩১ দফা বাস্তবায়নে আল মুজাহিদ মল্লিকের উঠান বৈঠক   |   প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মহানগর ছাত্রদলের রক্তদান ও ফ্রী মেডিকেল ক্যাম্পিং   |   বিএনপি একটি বড় দল এই দলের কোন অশুভ শক্তির জায়গা হবে না – সাখাওয়াত   |   সামর্থ্যহীন এমন ২ হাজার মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ সেবা প্রদান   |   শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে নগদ অর্থ প্রদান করেন মাসুদুজ্জামান মাসুদ   |   বিএনপি – জামাত – এনসিপি কেউ দুর্নীতির বাইরে নয় – জোনায়েদ সাকি   |   আনিসুল ইসলাম সানি’র সাথে জাসাস নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ   |   সঞ্চয় ও ঋণ গ্রহীতাদের টেকসই সেবা দিতে হবে – প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন    |   সন্ধি সংগঠনের উদ্যোগে ক্যারাম প্রতিযোগিতা পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত    |   কাশিপুর ইউনিয়ন জাকের পার্টির উদ্যোগে মিলাদ ও দোয়া   |   দেশে বিষমুক্ত কৃষি উৎপাদনে কৃষকদের সচেতনতা জরুরি—মহাপরিচালক
 প্রচ্ছদ   সাহিত্য   “ধর্ম যার যার” মানুষধর্মের সুরে বাঁধা ‘সমগীত’ এর অনন্য এক গান – আহমেদ বাবলু
ওই আসমানেরো ছায়া, এ জমিনেরো মায়া খুঁজে না খুঁজেনা তারা ধর্ম-জাতের কায়া / “ধর্ম যার যার” মানুষধর্মের সুরে বাঁধা ‘সমগীত’ এর অনন্য এক গান – আহমেদ বাবলু
  সাহিত্য || নারায়ণগঞ্জেরখবর.কম
প্রকাশিত: রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আহমেদ বাবলুঃ সমগীতকে যারা চেনেন জানেন তাদের সকলেরই অবগত থাকার কথা যে এই দলটির সকল গানই মানুষধর্মের সুরে বাঁধা গান। তবে গতকাল “ধর্ম যার যার” শিরোনামে যে গানটি আনুষ্ঠানিকভাবে সমগীত প্রকাশ করল, সে গানটি নিয়ে কিছু কথা তৈরি হয়েছে আমার, এই লেখায় সেটিই বলতে চাই।

যতটুকু মনে পড়ে গানটি প্রথম শুনেছিলাম ২০১২ কি ১৩ সালে। আজ থেকে ঠিক ১৩ বছর আগে এই সেপ্টেম্বর মাসেরই ২৯ তারিখে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার ধুয়া তুলে কক্সবাজারের রামুতে একটি সহিংস ঘটনা ঘটে। অনলাইনে সন্ধান করলে এখনো সেই সংবাদ পাওয়া যায় “২০১২ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার রামুতে একটি সংঘটিত ঘটনা, যেখানে ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে স্থানীয় জনতা কর্তৃক বৌদ্ধ বিহার, মন্দির ও বসতবাড়িগুলোতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই হামলার কারণ ছিল একটি ফেসবুক পোস্ট, যেখানে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে কোরআন অবমাননার ছবি ট্যাগ করা হয়েছিল। যদিও ছবিটি যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি পোস্ট করেননি, তবুও এটি দাঙ্গার সূত্রপাত করে এবং এতে অনেক বৌদ্ধ মন্দির ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।’’

সমগীতের আলোচিত গানটি সম্ভবত সেই ঘটনারই অভিঘাতে সৃষ্টি বলে মনে পড়ে। এরপর ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন এই গান নিয়ে মঞ্চে উঠেছিল সমগীত এবং সারাদেশব্যাপী তখন অনলাইনে আলোড়ন তুলেছিল, সেই স্মৃতিও উঁকি দেয় আমার করোটিতে। গানটি জন্মাবার পরপরই যখন শোনার সৌভাগ্য হয় আমার, তখনই এই গান আমাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিল, আন্দোলিত করেছিল। এত বছর পরে এই গানের রেকর্ডিং ও ভিডিও রিলিজ কেন জরুরি হয়ে পড়ল সেটি খুব সহজেই অনুমেয়। আজও চারিদিকে ধর্মের নাম নিয়েই একের পর এক হামলা হচ্ছে বিভিন্ন মন্দিরে, হামলা হচ্ছে মাজারে, লালনের বিভিন্ন আখড়ায়। হামলা হচ্ছে নারীদের ফুটবল বন্ধের দাবিতে এবং আন্দোলন হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায় সংগীত শেখার বিরোধীতা করে। এমন একটি আবহে সমগীতের “ধর্ম যার যার” সংগীতের যে প্রেমময় স্বর ও সুর, তা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্ববহণ করে।

গানের শুরুতেই সংগীত পরিচালক অর্ক সুমন দারুণ এক সাংগীতিক আবহ তৈরি করেন। যে আবহ, মুখে গান ফুটবার আগেই অসাম্প্রদায়িক এক স্বরের ইংগিত দিয়ে রাখেন যেন, আর সেই আবহ সংগীতে ভর করে ভেসে আসে মূল বাণী –

ওই আসমানেরো ছায়া, এ জমিনেরো মায়া
খুঁজে না খুঁজেনা তারা ধর্ম-জাতের কায়া

অর্থাৎ বিশ্ব স্রষ্টার – আসমান জমিন, আলো বাতাস, চন্দ্র সূর্য, সাগর নদী, ফুল পাখি বৃক্ষ এবং এই বিশ্ব প্রকৃতি, যখন আমাদের জীবনকে  টিকিয়ে রাখতে, বেঁচে থাকতে, বাঁচাটিকে অর্থবহ করে তুলতে, নিজ নিজ অবদান রেখে চলে, সে কাজে তারা কিন্তু ধর্ম-জাতের খবর নেয় না কারোর। যে আকাশ মুসলমানের, সেই একই আকাশ অন্য ধর্মেরও। যে চাঁদ সূর্য সাগর পাহাড় আশরাফের, ব্রাহ্মণের, সমানভাবে আতরাফের এবং শূদ্রেরও। আর কী আশ্চর্য! যে আকাশ অমানবিক রাষ্ট্র ইসরাইলের সেই আকাশটিই নির্যাতিত ও ক্ষত বিক্ষত ফিলিস্তিনের মানুষেরও!

এই কথাটিই তো সমগীত তার গানে মনে করিয়ে দিতে চায় এবং স্পষ্ট করে বলে ওঠে –

ধর্ম যার যার, দুনিয়া সবার
ধর্ম যার যার, এ বাংলা সবার।।

০২

এই বাণী কি বাংলায় নতুন কোনো বাণী? তা নয় কিন্তু। কয়েকশত বছর আগেও বাংলার প্রচলিত লোককাহিনী ভিত্তিক গাজীর গানে একই স্বরের উপস্থিতি দেখি। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠে বর্ণিত গাজীর গানের দুটি অসাধারণ লাইন পাওয়া যায় –

নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ;
জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।।

সমগীত এতদিন পরে এসেও সেই একই বাণীর প্রচারে গান বেঁধেছে, বলা যায় বাঁধতে বাধ্য হয়েছে। এই গানের অন্তরাতে এসেও গাজীর সেই গীতের মতো করেই তারা যেন ডেকে ডেকে বাংলার মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চায় –

ও বাংলার মুসলমান, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান
কে ছিলে বামুন-চণ্ডাল, কে ছিলে পাঠান?
এক দেহে তারা বইছে সারা
জগত ভ্রমিয়া দেখি এক মায়েরই ধারা।

এইখানে এসে গাজীর গানের স্বর আর সমগীতের গানের স্বর মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে। এরপর কীর্ত্তনাঙ্গের সুরে উঠে আসে বাংলার লোকায়ত সাংস্কৃতিক ইতিহাস –

তথাগত শোনালেন অমৃত গান
সুখী হোক জগতের সকল প্রাণ
এসেছে মুসলমান সুফি দরবেশ
মুক্তির বাণী শোনে শূদ্রের দেশ

এটাই এই বাংলার মানুষের আদি সংস্কৃতির ভাব। যেখানে বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে সমঝোতা করে গড়ে উঠেছিল দারুণ এক লৌকিকধর্মের। গত ১৩ আগস্ট ২০২৫ দেহত্যাগ করলেন আমাদের অগ্রজ চিন্তাবিদ, লেখক, অধ্যাপক যতীন সরকার। তিনি তাঁর ‘বাঙালির লৌকিক ধর্মের মর্মান্বেষণ’ নামক প্রবন্ধে লিখছিলেন –

“লৌকিকধর্মই ছিল বাঙালির স্বাভাবিক ধর্ম, পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শাস্ত্রীয় ধর্ম তার ওপর আরোপিত হয়েছে। এরপরেও বাঙালি তার স্বাভাবিক লৌকিক ধর্মকে ত্যাগ করেনি, শাস্ত্রীয় ধর্মের সমস্ত বিশ্বাস ও অনুশাসনকে হুবহু গ্রহণ করেনি, লৌকিক ধর্মের জারক রসে শাস্ত্রীয় ধর্মকেও রীতিমতো লৌকিক ক’রে নিয়েছে। এভাবেই বাংলার মাটিতে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে লৌকিক হিন্দু, লৌকিক বৌদ্ধ ও লৌকিক ইসলামের প্রসার ঘটেছে।”

এই যে বাঙালির লৌকিকধর্ম সেটি লোক সংস্কৃতির পাটাতনে কীভাবে ছাপ রেখেছে? যতীন সরকারের উল্লেখিত প্রবন্ধ থেকেই স্পষ্ট করা যাক –

“লোকসমাজের মুসলমান কবি যে অনায়াসে রাধাকৃষ্ণ-পদাবলি বা শ্যামা সংগীত রচনা করে যান, আর হিন্দু কবি রচনা করেন ‘ইমামের জঙ্গ’ কিংবা এসলাম সংগীত, তারও মূলে আছে লৌকিকধর্মের প্রেরণা”

সেই প্রেরণার বাণী দিক্বিদিক ছড়িয়ে দিতে এই বাংলায় আবির্ভাব হয়েছিল মুসলমান সুফি দরবেশদের, জন্ম হয়েছিল চৈতন্যদেব আর লালন ফকিরেরও। “ধর্ম যার যার” শিরোনামের এই গানে সেই ইতিহাসের বয়ানও হাজির করে সমগীত। গানে গানে
জানান দেয় –

চৈতন্যের প্রেমে ভাসলো নদীয়া
মানুষধর্মে বাঁধা লালনের হিয়া

লালনের এই হিয়া আসলে বাংলার সাধারণ মানুষেরই হিয়া। সুতরাং যখন যখনই বাংলামায়ের পুত্র ও কন্যারা নানান জাতে ও ধর্মে, মতে ও পথে, বিভক্ত হয়ে পড়েছে; অন্ধকারে ভরে তুলেছে বাংলার অসাম্প্রাদায়িক আয়তনকে, তখনই – মানুষে মানুষে প্রেমের গান নিয়ে শত শত বছর ধরে আমাদের আলোর পথ দেখিয়ে গেছেন লোকায়ত সংস্কৃতির প্রেমিক শিল্পীগণ। লালন সাঁই যেমন করে মনে করিয়ে দিয়েছেন মানুষকে ছাড়া ধর্মের মূলকে হারিয়ে ফেলার বয়ান, দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন মানুষকে ভজন করলেই সোনার মানুষ হয়ে ওঠার পথ, গানে গানে বলে গেছেন –

মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।।

বাউল রশীদ উদ্দিন যেমন নির্দেশ করেছেন –

মানুষ ধরো, মানুষ ভজো শোন বলি রে, পাগল মন
মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন।।

একইভাবে সমগীতের “ধর্ম যার যার” গানটিও আমাদের অন্ধকার ও অপ্রেমের এই সময়ে লালন ফকিরের স্বরে স্বর মিলিয়ে মানুষধর্মের সুরে বাঁধা এই সময়ের অত্যন্ত জরুরি ও অসাধারণ একটি গান। গানের মূল বক্তব্যকে ধরতে চেয়ে ভিডিওগ্রাফিতে তুলে আনা হয়েছে মুসলমান ও হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান, নারী ও পুরুষ, সাদা বা কালো, বাঙালি বা আদিবাসী, বিচিত্র – শ্রেণি, ধর্ম, পেশার, মানুষকে। কিছু কিছু দৃশ্যায়ন এবং তার সম্পাদনা গানটিকে আরও অর্থবহ করে তুলেছে। সুতরাং গানের জন্য গান নয়, মানুষের জন্য এই গানটি সকলকে শোনার আমন্ত্রণ জানাই। সাথে ভাবতেও।
এমন একটি গানের জন্য গানেরদল-সমগীত ও সংশ্লিষ্ট সকলকে আমার অভিনন্দন ও ভালোবাসা প্রকাশ করছি।।

কথা ও সুরঃ অমল আকাশ
মিউজিক: অর্ক সুমন
সংগীত পরিকল্পনা – অর্ক সুমন, অমল আকাশ
শব্দ গ্রহণ: বাংলা ঢোল
মিক্স মাস্টার: রোকন ইমন
কণ্ঠ: অমল আকাশ, বীথি ঘোষ, রেবেকা নীলা, অর্ক সুমন
রিদম গিটার: অর্ক সুমন, জয় দাস
ড্রামস: শরফুদ্দিন রাব্বি,
বেস গিটার: ফাহিম
মন্দিরা, খোল: সুমিত দাস
একতারা: অমল আকাশ
বাঁশি: সায়ন্তন
ক্যামেরা: অনিক, অমল আকাশ, রাব্বি হোসেন
এডিট: অমল আকাশ
কালার গ্রেডিং – জাহিদ ইকবাল সুমন
সুফি ডান্স: জিহাদ, শিশির, সুমিত, মিম, অর্ক রাব্বি, অনিক, জয়, অমল কোরিওগ্রাফি ডান্স: মাইম ফেস

লেখক কবি সাহিত্যিক
আহমেদ বাবলু
২০/০৯/২০২৫

গাছ লাগান পরিবেশ বাচাঁন, যোগাযোগ ভাই ভাই নার্সারী মোবাইল – ০১৭১২২৫৬৫৯১