নারায়ণগঞ্জ  সোমবার | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ শীতকাল | ২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬

শিরোনাম
  |   বাংলাবাজারে জাকের পার্টির মিশন সভা ও জলছা মাহফিল অনুষ্ঠিত   |   আড়াইহাজার বাজারে হাত-পা বেঁধে ৪ দোকানে ডাকাতি   |   নারায়ণগঞ্জ ক্লাব নির্বাচনে জয়ি হওয়ায় ভোটারদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন হৃদয়    |   ১২ মামলার আসামী সালামের চেয়ারম্যানের ডান হাত সন্ত্রাসী সোহেল বাহিনী বেপরোয়া    |   নিহত মেধারী শিক্ষার্থী ওয়াজেদ সিমান্ত হত্যার বিচার কার্যকর ও নিরাপত্তার দাবিতে মানববন্ধন   |   জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হলেন মমিনুর রশিদ শাইন    |   জাতীয় পরিবেশ মানবাধিকার সোসাইটির শীতবস্ত্র বিতরণ | জেলার নতুন কমিটি ঘোষনা    |   পূর্বাচলের লেক থেকে অজ্ঞাত তরুণীর মরদেহ উদ্ধার   |   মহান বিজয় দিবসে রূপগঞ্জে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আলোচনা সভা   |   নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনের সাবেক এমপি এস.এম. আকরামের মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা    |   তারেক জিয়া নেতৃত্বে দেশবাসীকে একটি নতুন বাংলাদেশ উপহার দিব- মুকুল   |   মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান ও প্রীতি ফুটবল প্রতিযোগিতা    |   শহীদ বুদ্ধিজীবী  দিবসে বন্দরে বধ্যভূমিতে উপজেলা প্রশাসনের পুষ্প অর্পন    |   বিপিজেএ না’গঞ্জ কমিটির সাক্ষাৎ / অপসাংবাদিকতা পরিহারের আহবান জানালেন – হাতেম   |   লায়ন্স ক্লাব ১৮০০ মানুষকে সেলাই মেশিন, ভ্যানগাড়ি, শীতবস্ত্র, স্কুল ব্যাগ বিতরন সহ স্বাস্থ্যসেবা দিল   |   জাতীয়তাবাদী গার্মেন্টস শ্রমিকদলের নারায়ণগঞ্জ জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত   |   বিএনপির ৩১ দফার সমর্থন আদায়ে সোনারগাঁওয়ে উঠান বৈঠক   |   আড়াইহাজারে ৮ কেজি গাজা সহ গ্রেফতার ২    |   রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, না’গঞ্জ জেলার আলোচনা সভা   |   নারায়ণগঞ্জ ফটো জার্নালিস্টস এসোসিয়েশন নবগঠিত কমিটিকে বন্দর প্রেসক্লাবের শুভেচ্ছা
 প্রচ্ছদ   সংস্কৃতি   ২৮ জুন জোটের সেমিনারে রফিউর রাব্বির প্রবন্ধ জালালুদ্দিন রুমী আন্তধর্ম দর্শন
২৮ জুন জোটের সেমিনারে রফিউর রাব্বির প্রবন্ধ জালালুদ্দিন রুমী আন্তধর্ম দর্শন
  সংস্কৃতি || নারায়ণগঞ্জেরখবর.কম
প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪
নারায়ণগঞ্জের খবর প্রতিবেদকঃ আগামী শুক্রবার ২৮ জুন নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের দ্বি – বার্ষিক কর্মসূচির সেমিনার। এ সেমিনারের বিষয় জালালুদ্দিন রুমী আন্তধর্ম দর্শন। আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে পরীক্ষণ হলে বিকাল ৫.০০ টায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে রফিউর রাব্বির প্রবন্ধে আলোচনায় অংশ নেবেন জাহিদুল হক দীপু , রহমান সিদ্দিক। অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক সংগঠন রাজনৈতিক সহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ উপস্থিত থাকবেন। রফিউর রাব্বির রচিত মূল প্রবন্ধে এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে।
জালালুদ্দিন রুমী : আন্তধর্ম দর্শন
রফিউর রাব্বি
জালালুদ্দিন রুমী ১২৭৩ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর শবযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন মুসলিম-ইহুদী-খৃস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ। অংশ নিয়েছিলেন স্বয়ং সালজুকের শাসনকর্তা। তিনি শবযাত্রায় অংশ নেয়া ইহুদী ও খৃস্টানদের প্রশ্ন করেছিলেন, মাওলানা রুমীর সাথে কী সম্পর্ক যা তোমাদেরকেও এই শোকের অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছে? উত্তরে তারা শাসনকর্তাকে বলেছিলেন, ‘মৃত ব্যক্তি যদি আপনাদের মুহাম্মদ (সাঃ) হন, তাহলে তিনি আমাদের যীশু ও মূসা।’ সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে যিনি আদি ও অন্তহীন, পরম ও অসীম সত্ত¡া, যিনি সমাসীন হয়েছেন সীমাবদ্ধ মানুষে- সে সত্যের উপলব্ধি জালালুদ্দিন রুমীকে বিস্মিত করেছে, তন্ময় করেছে, বিমোহিত করেছে। তিনি নিমজ্জিত হয়েছেন, দ্রবীভ‚ত হয়েছেন যেমনি জলে চিনি বা লবন বিলীন হয়ে যায়। রুমীর কবিতার ছত্রে ছত্রে সে উপলব্ধি ও দর্শনেরই প্রতিফলন ঘটেছে।
ফার্সী ভাষায় রচিত গ্রন্থের মধ্যে সাধারণত চারটি গ্রন্থকে বিখ্যাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’, শেখ শাদীর ‘গুলিস্তাঁ’, রুমীর ‘মসনবী’ এবং হাফিজ-এর ‘দিওয়ান’। এসবের মধ্যে মসনবী সারাবিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত গ্রন্থ। মসনবীকে ফার্সী ভাষার কোরআন বলেও কেউ কেউ উল্লেখ করে থাকেন। মসনবীতে সুফী কাব্যের চ‚ড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে। এতে রয়েছে ধর্মের শিকড়, প্রকৃতি ও চিরন্তন জ্ঞানের রহস্য। রূপকে উপস্থাপিত ছয় খÐের কাব্য মসনবী রচনায় রুমীর সময় লেগেছে দশ বছর।
১২০৭ খৃস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর বলখ্-এ জালালুদ্দিন রুমীর জন্ম। পিতা শেখ বাহাউদ্দিন বলখী সে সময়ের খ্যাতিমান ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। সকল বিষয়ের উপরেই অগাধ জ্ঞান ও পাÐিত্য ছিল। যে কোন বিষয়ের উপরই তিনি অনায়াসে বক্তৃতা করতে পারতেন। তাঁর পাÐিত্যের কথা তদ্ লের সর্বত্র প্রচারিত ছিল। বাহাউদ্দিন তৎকালীন স্থানীয় শাসক খোয়ারিজম শাহ-এর আত্মীয় ছিলেন। খোয়ারিহম শাহ পরবর্তী সময়ে বাহাউদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর বাহাউদ্দিনের বংশের উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ ছিলেন। সে সময় বলখ্-এ বাস করতেন বিখ্যাত দার্শনিক ও পÐিত ফখরুদ্দিন রাজী। তিনিও খোয়ারিজম শাহ-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু বাহাউদ্দিন ফখরুদ্দিনের দর্শন ও মতবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। একসময় এ বিরোধ এতটাই চরমে পৌঁছে যে, বাহাউদ্দিন তাঁর জন্মভ‚মি বলখ্ ছাড়তে বাধ্য হন। তখন জালালুদ্দিন রুমীর বয়স পাঁচ বছর।
রুমী জীবনের দীর্ঘ সময় কেনিয়ায় অতিবাহিত করেছেন। এটি ছিল তুরস্কের পশ্চিমে অবস্থিত এশিয়া-মাইনর অ লের অন্তর্গত। সে সময় এ অ লকে রোমানদের ভ‚মি বা রুম বলে অভিহিত করা হতো। আর তাই জালালুদ্দিনের নামের সাথে রুমী নামটি যুক্ত হয়ে পরবর্তীকালে রুমী নামেই তিনি সমধিক পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর নামের পূর্বে ‘মাওলানা’ শব্দটি যুক্ত করা হয়। মাওলানা আরবী শব্দ। যার বহুবাচক অর্থ রয়েছে। আরবীতে এর প্রায় ত্রিশটি সমার্থক শব্দ পাওয়া যায়; যেমন প্রভু, বন্ধু, সাহায্যকারী, মনিব, প্রতিনিধি, অভিভাবক, নেতা, গুরু, শিক্ষক, প্রতিবেশি, প্রেমিক, দÐায়মান ইত্যাদি। তবে কোরআনে চারটি অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছেÑ বন্ধু, সহযোগী, বাসস্থান এবং ওস্তাদ বা আলোম।
রুমীর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত তৈরি হয় পিতার তত্ত¡াবধানে। দর্শনের মৌলিক তত্ত¡ ও আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা তিনি পিতার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছেন। পরে পিতা তাঁর অনুসারী সাইয়েদ বোরহানউদ্দিন মোহাক্কিককে পুত্র জালালুদ্দিন রুমীর শিক্ষাদানের জন্য নিযুক্ত করেন। রুমী বোরহানউদ্দিনের কাছে ধর্মীয় ও জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। বোরহানউদ্দিনই রুমীকে সুফী তত্ত¡জ্ঞানে উজ্জ্বীবিত করেন। রুমী দামেশ্ক ও আলেপ্পো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন। ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন, তর্কশাস্ত্র ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি এখান থেকেই জ্ঞান লাভ করেন। আরবী, ফার্সী, তুর্কী ও গ্রীক এই চারটি ভাষায়ই সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন রুমী। এসবগুলো ভাষাতেই তিনি একাধারে কবিতা লিখতে পারতেন।
রুমীর জীবন-দর্শনে আমুল পরিবর্তন আনেন শামসুদ্দিন তাবরেজী। শামসুদ্দিন তাবরেজী বা শামস-ই-তাব্রিজ-এর সাথে জালালুদ্দিন রুমীর সাক্ষাতের পরে রুমীর চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে থাকে। শামস-ই-তাব্রিজ আজারবাইজানের অন্তর্গত তাব্রিজ শহরের অধিবাসী। ১১৮৫ খৃস্টাব্দে তাঁর জন্ম। প্রকৃত নাম মুহাম্মদ শামসুদ্দিন। শামসুদ্দিন আরবী শব্দ। যার অর্থ দিনের সূর্য; আবার শামস নামে আরবে একটি পাখি ছিল যা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াত। শামস-ই-তাব্রিজ দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়াতেন বলেই ভ্রাম্যমান সে পাখির সাথে মিলিয়ে এবং তাব্রিজ শহরের অধিবাসী হওয়ায় তাঁর এই নাম বলে অনেকেই মনে করেন। প্রচলিত শিক্ষার বাইরে ছিল তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞান। জ্ঞান ও শক্তিতে তিনি এমনি পর্যায়ে পৌঁছেন যে, প্রচÐ তৃষ্ণা, অতৃপ্তি ও ব্যাকুলতায় সারাক্ষণ অস্থির থাকতেন। প্রকৃত বন্ধুর অন্বেষণে দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। নিজের প্রকৃত অবস্থা গোপন রাখতে বণিকের বেশে ঘুরে বেড়াতেন। শামস-ই-তাব্রিজের সাথে পরিচয়ের পর যেন খোলসের আচ্ছাদন খুলে ফেললেন রুমী। বায়েজীদ বোস্তামী যেমনি বলেছেন, ‘সাপ যেমন তার খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আমিও তেমনি বায়েজীদ সত্ত¡ার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে চতুর্দিকে তাকালাম। দেখলাম প্রেমিক, প্রণয়-পাত্র ও প্রেম সবই এক। মিলনের জগতে সবই এক হতে পারে।’ রুমীর কাছে তেমনি জাগতিক ও প্রচলিত সকল শিক্ষা, গ্রন্থ, পুঁথিপত্র তখন অসার ও মূল্যহীন হয়ে যায়। জ্ঞানের অতিউচ্চতর শৃঙ্গে তখন তিনি আরোহন করেছেন। তাব্রিজের সাথে পরিচয় হওয়ায় আগে যেখানে রুমী গান-গজল থেকে দূরে থাকতেন, পরিচয় হওয়ার পরে রুমী সারাক্ষণ প্রেমে মশগুল হয়ে গজল ও শায়েরে ডুবে থাকতেন। শিক্ষকতা, বক্তৃতা, ওয়াজ-নসিহত, ফতোয়া লেখা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলেন। তিনি বললেন, ‘সব গ্রন্থ, পুঁথিপত্র যত সাগরে নিক্ষেপ করো, আগুনে পুড়িয়ে দাও।’ জ্ঞানচর্চার পথ কেবল বুদ্ধির চর্চাই নয়, তা বোধের চর্চাও।
শামস-ই-তাব্রিজ যেন রুমীর ঘি-মাখা শুকনো কাঠে আগুন ধরিয়ে দিলেন। দাউ দাউ সে আগুনে চারপাশ যেমনি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলো পাশাপাশি ভষ্মীভ‚ত হতে থাকলো আচার, লৌকিকতা আর ধর্মের পোশাকী আনুষ্ঠানিকতা। রুমী সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে তাব্রিজকে নিয়ে মত্ত হলেন। রুমী তাব্রিজকে নিয়ে ‘দিওয়ান-ই-শামস’ গ্রন্থ রচনা করলেন যা ‘কুল্লিয়াতে শামস-ই-তাব্রিজ’ নামে প্রকাশিত হয়। দিওয়ান-ই-শামস-এ তিনি লিখেছেনÑ
বিশ্বের সম্পদ মৃতদেহের মতো,
এ মৃতদেহকে আমরা কুকুরের সামনে ফেলে দিয়েছি।
কোরআনের সারবস্তু আমরা বের করে নিয়েছি,
আর বাইরের খোলসটা দিয়েছি কুকুরদের।
মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত সকল জায়গায়
আমরা ছড়িয়ে দিয়েছি শাশ্বত উল্লাস ও আনন্দের বীজ।
তালি-দেওয়া জোব্বা, জায়নামাজ ও তস্বিহ,
আমরা পরিত্যাগ করেছি আত্মার সরাইখানায়।
ধার্মিকতার পোশাক, পাগড়ি ও জ্ঞানের গরিমা
নিক্ষেপ করেছি আমরা প্রবহমান নদীতে।
আকাক্সক্ষার ধনুকে দিব্যজ্ঞানের তীর সংযোজিত করে
স্থিরভাবে লক্ষভেদ করেছি আমরা।
শামস্-তাব্রিজ, তুমি সত্যি বলেছ-
আমরা নিক্ষেপ করেছি প্রেমের দৃষ্টি-
আত্মার প্রভুর উদ্দেশ্যে।
দিওয়ান-ই-শামস্-এর বিভিন্ন কবিতায় সুফীতত্তে¡র অন্তর্নিহিত রহস্য বিবৃত হয়েছে। কোথাও তা উন্মোচিত আবার কোথাও অপ্রকাশ্য। শামস-ই-তাব্রিজ-এর সাথে পরিচয় হওয়ার পূর্বে রুমীর জীবন ছিল অসংখ্য মানুষের সাথে সম্পর্কিত, জৌলুসে। যেখানেই যেতেন বহু অনুসারী, গুণগ্রাহী ও বিদ্বান ব্যক্তিরা তাঁর সঙ্গী হতেন। তাব্রিজের সাথে পরিচয় হওয়ার পর রুমী সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধু তাঁর সাথেই মশগুল থাকতেন। রুমী বলেন, ‘সমগ্র রুমের অধিবাসী- রাজা, বাদশাহ্, ধনী, বণিক, ওলামা-মাশায়েখ এবং আমীর ওমরাহ্ যতদিন জালালুদ্দিনের দাস ছিল ততদিন জালালুদ্দিন ছিল মৌলবী জালালুদ্দিন কাউনাবী; কিন্তু যেদিন ক্রীতদাসরূপে নিজেকে শামস-ই-তাব্রিজের পায়ে সমর্পণ করলাম, সেদিন থেকে আমার নাম হল মাওলা-এ রুমী।’ এতে রুমীর অনুসারী, পুত্র-পরিজন তাব্রিজের উপর ক্ষিপ্ত হতে থাকল। সর্বত্র প্রচারিত হয় জাদুকর শামস-ই-তাব্রিজ রুমীকে জাদু করে বশ করে নিয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, একসময় তাব্রিজী রুমীকে না বলেই কাউনিয়া ছেড়ে দামেশ্ক চলে যান। তাব্রিজির শূন্যতা রুমীকে আরো ব্যাকুল করে তোলে। তাঁর নাওয়া-খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি লিখলেনÑ
আমি ছিলাম যেন একটা খোলা মুক্তা
অকস্মাৎ যেন আশ্রয় নিলাম ঝিনুকের বুকে।
তাঁর করুণার সূর্যকিরণে আমি হয়ে উঠলাম উত্তপ্ত;
সেখান থেকে আবার আত্মপ্রকাশ করলাম সময়ে।
বিশ্বজনীন প্রজ্ঞার সাথে একবার আমার গোপন কথা হয়,
কিন্তু আবার আমি উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়ালাম
মরু-প্রান্তরে।
লক্ষ লক্ষ বছর আগে, বহু শতাব্দী পূর্বে-
এমন কি আদম-হাওয়ার আগেও ছিলাম আমি।
নীরব যারা, একদা তাদেরি মধ্যে ছিলাম আমি,
সে নীরবতা থেকেই আজ হয়ে উঠেছি সবাক মুখর।
রুমীর এরকম অবস্থা দেখে তাঁর ছেলে ও অনুসারীরা শামস-ই-তাব্রিজকে খুঁজতে বের হন। দামেশ্ক থেকে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁদের এ মিলন খুব দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিছুদিন পরেই আরেক ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে স্থায়ী বিচ্ছেদ তৈরি হলো। এক সকালে শামস-ই-তাব্রিজের অন্তর্ধান ঘটে। পরে রুমী সকলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী বসে বিচ্ছেদগাঁথা গাইতেন, কবিতা আওড়াতেন, কখনোবা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠতেন। এসময় থেকে তিনি ‘মসনবী’ রচনা শুরু করেন। মসনবীর শুরু হয়েছে এইভাবেÑ
কান পেতে শোন, বাঁশী কী বলে,
কোন বিরহ-বিচ্ছেদের কথা বলে,
বাঁশ বন থেকে যখন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে
আমার কান্না ও আর্তনাদে তখন
নারী-পুরুষ সকলে কেঁদেছে,
বিরহ বেদনায় যাদের হৃদয় বিদীর্ণ,
আমার প্রেম-বেদনা প্রকাশের জন্য প্রয়োজন
তেমনি চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ হৃদয়
যে ব্যক্তি আপন কক্ষচ্যুত হয়েছে
সে পুনরায় হারানো মিলনযুগ অন্বেষণ করে-
পুরো মসনবী জুড়ে রয়েছে সুফীতত্তে¡র, ধর্মের ও সৃষ্টিতত্তে¡র মৌলিক নির্যাস; যার সবই প্রতীকী রূপে। মনসুর হাল্লাজ তাঁর ‘কিতাব আল তাওয়াসিন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে বলে, “তার সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা আছে বলেই আমি তাকে জানি”- অজ্ঞতা কেবল একটি আবরণ এবং গুপ্তজ্ঞান আবরণকে ছাড়িয়ে যায়। তা যদি না হয় তবে তার কোন বাস্তবতা নেই।’ বাগদাদে একসময় মনসুর হাল্লাজের ‘আনা-আল-হক্ক’-এর সমালোচনা করে কেউ কেউ যখন প্রশ্ন তুললেন, হাল্লাজের ‘আমি’র সাথে ফারাওয়ের ‘আমি’র তফাৎ কই? জালালুদ্দিন রুমী তার উত্তরে বলেছেন, ‘ফারাও কেবল নিজেকে দেখেছিল যখন হাল্লাজ দেখেছিল কেবল শাশ্বতকে। তাই তাঁর দাবী অনুগ্রহ লাভ করেছিল আর ফারাওয়ের দাবী অভিশাপ বয়ে এনেছিল।’ হাল্লাজের পূর্বে বায়েজীদ বোস্তামীও এই ‘আমি’তত্ত¡ উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি হলাম মদ্যপানকারী, মদ্য এবং মদ্য পরিবেশক সাকীও।’ গীতায় বলা হয়েছে সাধনার এ পর্যায়ে সাধক বলেওঠেন, ‘অহং ব্রহ্মোস্মি’ আমি ব্রহ্ম হয়েছি। তখন তিনি ‘সোহহংতত্ত¡’ অনুভব করেন।
এই ‘আমি’র সন্ধান করাই সূফী বাউল ফকীরদের সাধনা। নিজেকে জানার সাধনা। আর এ আমিত্ব লয় না হলে সাধনা পূর্ণও হয় না। ‘আমি আমার ধর্মাধর্মের সত্য পরিচয়/ আমি আমার জানা কি আর, শাস্ত্র পড়ে হয়?’ এইটি ছায়ার মধ্যে ডুব দিয়ে কায়ার সন্ধান। শাস্ত্র পাঠে তা হয় না। ‘আপনি আপন ভাসে রূপ, স্বরূপেতে হয় লয়’- এ মনোমোহন দত্তের কথা। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ সত্তার অস্তিত্ব অন্বেষণে বিভোর হয়েছে, আত্মহারা হয়েছে। সৃষ্টি-রহস্যের জিজ্ঞাসা মানুষকে সংসারবিরাগী করেছে। সূফী-বাউলদের আত্মতত্ত¡ই সকল রহস্যের দ্বার। আত্মতত্ত¡ সাধকের সাধনার মূল লক্ষ্য। উপনিষদে উচ্চারিত হয়েছে ‘আত্মানাং বিদ্ধি’- নিজেকে জানো। আর হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, ‘মান্ আরাফা নাফছাহু, ফাক্কাদ আরাফা রাব্বাহু’- যে নিজেকে চিনেছে সে তার প্রভুকে চিনেছে। উপনিষদ, হাদীসে কুদসী বা সক্রেটিসের ‘নো দাই সেলফ্’ আর সূফী-বাউল-ফকীরদের আত্মতত্তে¡র উৎস-কেন্দ্র অভিন্ন।
সাধনার যে পর্যায়ে সাধকের আমিত্ব ঘুচে যায় জগত তখনই তার কাছে হয়ে ওঠে আমিময়। সত্তার অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে ফানার স্তরে উন্নীত হলে সেখানে এক ভিন্ন দ্বৈতের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু এর পূর্বেই যত সংশয়, ব্যাকুলতা, অস্থির উচ্চারণ। প্রেমাস্পদের সাথে প্রেমিকের মিলনের সুতীব্র বাসনা ও যন্ত্রণার হাহাকার। প্রেমিক আত্মহারা হন স্তরভেদের ভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। এ প্রসঙ্গে জালালুদ্দিন রূমী বলেছেন, ‘একজন ঐ ব্যক্তি, যার মুখ বন্ধুর প্রতি নিবদ্ধ, আর একজন ঐ ব্যক্তি যে, বন্ধুর মুখই তার মুখ।’ প্রথমটি থেকে দ্বিতীয়টির অবস্থান ভিন্ন। প্রথমটিতে গভীর নিমগ্নতা আর দ্বিতীয়টি স্রষ্টার সত্তায় স্বীয় সত্তা ফানা বা বিলীন করে দেয়া। তুমি ও আমির এ এক তত্ত¡জ্ঞান; যা অপ্রকাশ্য। প্রকাশিত হলেই যত বিভ্রাট। মনসুর হাল্লাজের মতো মৃত্যুদÐ। এ রহস্য প্রকাশিত হলে শাস্ত্রীয় ধর্মের ভিত নড়ে ওঠে। শরীয়তের পর্দা থাকে না। মনসুর হাল্লাজ বলেছেন, ‘সূফী লোকের সত্তা পৃথিবীতে একক পদার্থ- সেও কাউকে চিনে না, তাকেও কেউ চেনে না। সূফী সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহ্তায়ালার ইচ্ছায় চলেন, অথচ মানুষ আল্লাহ্তায়ালার দিকে ইচ্ছা করে থাকে। অর্থাৎ সূফী লোক নিজের সত্তাকে মধ্যস্থল থেকে বিলুপ্ত করে দেয়। সমস্ত সৃষ্ট জগতকে ফানার স্তরে দেখতে পাওয়াই তাসাওউফ।’ মনসুর হাল্লাজ যখন শূলের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন তখন উচ্চস্বরে বলেন, ‘আমার বন্ধু আমার প্রতি মোটেই অবিচার করেন নাই। তিনি আমাকে এমন সুরা পান করালেন যা শুধুমাত্র সম্মানিত অতিথিদেরই করানো হয়ে থাকে। সুরার পেয়ালা ঘুরাতে ঘুরাতে বন্ধু তরবারি আনার নির্দেশ দিলেন। এ যেন সেই ব্যক্তিরই সমুচিন শাস্তি যে গরমের দিনের বিশাল অজগরের সামনে বসে পুরোনো সুরা পান করেন।’ রূমী তাঁর ‘মসনবী’তে বলেছেন, ‘প্রেমিক তখনি সন্তুষ্টি লাভ করেন যখন তিনি প্রেমাষ্পদের নিজ হাতে নিহত হন।’ প্রেমের মত্ততা ও ব্যাকুলতায় প্রেমিক যখন বুঁদ হয়ে থাকেন তখন সেখানে লাইলীর কোন অস্তিত্ব থাকে না। সর্বত্র কেবল লা-এ-লা’র জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়। গীতার একাদশ অধ্যায়ে অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শন করতে গিয়ে অনুভব করেন, ‘দিবি সূর্য সহস্রস্য ভবেদ যুগপদুত্থিতা। যদি ভাঃসদৃশী সা সাৎ ভাসস্তম্য মহাত্মনঃ’ আকাশে যদি যুগপৎ সহস্র সূর্যের প্রভা উত্থিত হয়, তাহলে সেই সহস্র সূর্যের প্রভা বিশ্বরূপের প্রভার তুল্য হতে পারে। সাধনার একটি পর্যায়ে গুরু এবং শিষ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। তখন শুধু ব্রহ্মাকে লাভ করা নয়, ব্রহ্ম হয়ে যাওয়া। এ পর্যায়েই সাধক বলে ওঠেন, ‘অহং ব্রহ্মোস্মি’, আমি ব্রহ্ম হয়েছি। মনসুর হাল্লাজ বলেন, ‘আনাল হক’ আমি সত্য, আমিই পরম সত্তা।
ধর্মের আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপের অসারত্ব উন্মোচন করেছেন রুমী। উন্মোচন করেছেন এর শাশ্বত রূপকে, সত্যকে। মূসা ও মেষপালক কবিতায় রুমি বলেছেনÑ
একদিন মুসা নবী শুনছিলেন রাস্তার ধারে বসে এক মেষপালক
প্রার্থনা করছে,
‘হে খোদা,
তুই কই? আমি তোরে সাহায্য করতে চাই- আমি তোর জুতা
সেলাই করতে চাই,
চুল আঁচড়ে দিতে চাই, তোর কাপড় কাচতে চাই, উঁকুন বাছতে চাই,
আমি তোরে দুধ খাওয়াইতে চাই। যখন তোর ঘুমাতে যাওয়ার
সময় হবে,
আমি তোর ছোট ছোট হাত-পায় চুমু খেতে চাই। আমি তোর ঘর-দুয়ার
ঝাড়– দিয়ে সাফ রাখতে চাই। হে খোদা, আমার ছাগল-ভেড়া
সব তোর।
তোরে আমি যখন স্মরণ করি, তখন শুধু বলতে পারি
আই-ই-ই আর এ্যাঁ-এ্যাঁ-এ্যাঁ-এ্যাঁ।’
মুসা নবীর আর সহ্য হলো না
‘তুই কার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিস?’
‘যে আমারে বানাইছে,
যে বানাইছে এই দুনিয়াদারি আর আসমান।’
‘জুতা-মোজা নিয়া খোদার
লগে বাহাস চলে না! ছোট ছোট হাত-পায়ের
ব্যাপার কী? এটা তো বø্যাসফেমি- তুই যেন চাচা-মামার সাথে
কথা বলছিস।
দুধ তো তার জন্য,
যে বর্ধিত হয়। আর জুতো দরকার তার, যার পা আছে।
খোদার জন্য নয়!
তুই যদি এমনকি পয়গম্বরের কথাও বলে থাকিস,
যেমন খোদা বললেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম, তোমরা আমাকে
দেখতে আসোনি’,
এভাবে বলাটাও বোকামি এবং অসম্মানের।
সঠিক শব্দ ব্যবহার কর। ফাতেমা নামটা মেয়েদের জন্য
ঠিক আছে, কিন্তু তুই যদি কোনো
পুরুষমানুষকে ফাতেমা ডাকিস, তা অপমানজনক।
দৈনন্দিনের ভাষা এপাড়ের মানুষের জন্য,
খোদার জন্য নয়।’
মেষপালক অনুতপ্ত হলো। পোশাক ছিঁড়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে
মরুভ‚মির পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হঠাৎ ওহি নাজেল হলো
মুসা নবীর ওপর, খোদার আওয়াজ :
আমার একজনের কাছ থেকে
তুমি আমাকে বিচ্ছিন্ন করেছো। তুমি পয়গম্বর হয়ে মিলন ঘটাতে
না ভাঙানি দিতে এসেছো?
আমি প্রত্যেককে আলাদা এবং বিশিষ্টভাবে দেখার,
বুঝতে পারার
আর জ্ঞান প্রকাশ করার ক্ষমতা দিয়েছি।
যা তোমার কাছে ভুল অন্যের কাছে ঠিক, যা তোমার কাছে বিষ
অন্যের কাছে অমৃত
পবিত্র কি অপবিত্র, প্রার্থনায় অলস কি তৎপর
আমার যায় আসে না।
আমি এসবের ঊর্ধ্বে।
এবাদতের তরিকা দিয়ে ভালোমন্দ বিচার করা যায় না।
হিন্দুরা হিন্দুদের মতো করে
ভারতের দ্রাবিড় মুসলমান তাদের মতো করে।
এসবই প্রশংসা, এসবই সঠিক।
এবাদত-বন্দিগির মাধ্যমে আমি মহিমান্বিত হই না,
যারা করছে তারাই হচ্ছে। আমি তাদের শব্দগুলি শুনি না
আমি দেখি, অন্তরে তারা কতখানি বিনয়ী।
                               নীচতাকে ভেঙে বেরিয়ে আসাটাই সত্য,
ভাষা নয়! ভাষার অলঙ্কার ভুলে যাও।
আমি চাই আগুন, আগুন
বন্ধু ভাবো
তোমার জ্বলুনির সাথে বন্ধুত্ব করো। তোমার ভাবনা ও
প্রকাশকে অগ্নিদগ্ধ করো!
মুসা,
যারা কথায় আর আচরণে মনোযোগ দেয় বেশি
তারা এক ধরনের।
আশেক যারা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়
তারা অন্য ধরনের।
পোড়া গ্রামের ওপর করারোপ করো না,
প্রেমিককে বকো না।
তার ‘ভুল’ বলাটা ভালো, অন্যদের একশ গুণ ‘সঠিক’ কথার চেয়ে।
কাবার ভিতর
তোমার জায়নামাজ কোনমুখী তাতে যায় আসে না!
সমুদ্রে যে ঝাঁপায়, স্নো-শু’র তার দরকার নেই
প্রেমধর্মের ধরাবাঁধা নিয়ম বা মতবাদ নেই
শুধু খোদা
চুনিতে তাই নকশা থাকে না!
তাতে দাগের দরকার নেই।
খোদা গভীর তত্ত¡কথা বলতে লাগলেন মুসা নবীকে
দৃষ্টি ও ভাষায় যা রেকর্ড করা যায় না
সেটি তার ওপর বর্ষিত হলো এবং তিনি তা আত্মস্থ করলেন
তিনি নিজেকে ছেড়ে গেলেন তারপর ফিরে আসলেন,
তিনি অমরলোকে গমন করলেন, আবার এইখানে ফিরে এলেন
তা বারংবার ঘটল।
এসব বলার চেষ্টা আমার জন্য বোকামি।
আমি যদি তা বলেও থাকি,
তা আমাদের মানবিক বোধবুদ্ধি শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলবে।
তা আমাদের সব লেখনী চুরমার করে দেবে।
মুসা মেষপালকের পিছনে ছুটলেন
তিনি বিক্ষিপ্ত পায়ের ছাপ অনুসরণ করলেন-
দাবার ঘরের কিস্তির মতো সোজাসুজি এক জায়গায়।
আরেক জায়গয় আড়াআড়ি
বিশপের মতো
এই মুহ‚র্তে তিনি ঢেউয়ের ফণার মতো উত্তুঙ্গে উঠলেন,
পরের মুহ‚র্তে নেমে গেলেন মাছের মতো।
তার পায়ের ছাপ সবসময়
বালির বুকে প্রতীক রচনা করে গেল,
রেকর্ড রাখল
তার বিক্ষিপ্ত পদচারণার।
অবশেষে মুসা নাগাল পেলেন
মেষপালকের
‘আমি ভুল ছিলাম। খোদা আমাকে দেখালেন-
এবাদতের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
তা-ই বলো
তোমার ভালোবাসা যখন যা বলে, তোমার মিষ্টি বøাসফেমিই
সঠিক প্রার্থনা। তোমার মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ জগৎ
মুক্তি পায়।
তোমার জবান মুক্ত করে দাও, এ নিয়ে ভেবো না,
এ আত্মারই আলো।’
মেষপালক উত্তর দেয়
‘মুসা, মুসা,
আমি এইসবের বাইরে চলে গেছি।
তুমি চাবুক মারলে আর আমার ঘোড়া চমকে লাফ মেরে
নিজেকে ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দৈবপ্রকৃতি আর আমার মানবিক প্রকৃতি
মিলিত হলো।
তোমার তর্জনী আর শক্তিকে সেলাম
আমি বলতে পারছি না যে কী ঘটেছে।
আমি এখন যা বলছি,
তা আমার আসল অবস্থা না, এসব বলা যায় না।’
মেষপালক চুপ করে গেল।
তুমি যখন আয়নার দিকে তাকাও,
নিজেকেই দেখো, আয়নাটা কেমন দেখো না।
বংশীবাদক বাঁশির মধ্যে নিশ্বাস ফেলে
আর কে সঙ্গীত রচনা করে? বাঁশি নয়।
বংশীবাদক!
তুমি যখন খোদাতে প্রশংসা করো
বা ধন্যবাদ জানাও, এটা সবসময়
প্রিয় মেষপালকের সারল্যের মতো।
শেষ পর্যন্ত তুমি যখন
পর্দার মধ্য দিয়ে দেখতে পাও আসল ব্যাপারগুলো কী,
তুমি বারবার বলতে থাকবে,
‘আমরা যা ভেবেছিলাম,
অবশ্যই তা নয়।’
এ কবিতায় রুমী যেমনি ধর্মের পোশাকী আচ্ছাদন খুলে ফেলেছেন তেমনি এসবের ঊর্ধ্বে যে শাশ্বত সত্ত¡া যার কাছে এসবকিছুই মূল্যহীন, যিনি আদি ও অনন্ত, ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের সীমারেখায় যাকে কখনোই বাঁধা যায় না, কোন আনুষ্ঠানিকতা বা ভাষা দিয়ে যাকে স্পর্শ করা যায় না, যে সত্যের উপলব্ধি মানুষকে ঘর-সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এ কবিতা সে সত্যেরই প্রতিধ্বনি তুলেছেন। শেখ সাদী বলেছেন, ‘শুরু করি তাঁর নামে, যাঁর কোন নামই নেই; অথচ যে নামেই তাঁকে ডাকা হয় তাতেই তিনি মাথা তোলেন।’ কিন্তু সেই নামহীন, গোত্রহীন মহাসত্বাকে, সত্যকে বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন গোত্রে প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার-হাজার বছর ধরে যে সহিংস-মহাযজ্ঞÑ রুমীর দর্শন তারই বিরুদ্ধে।
এ অ লে বৈষ্ণব ও সূফীবাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠেছে মরমীয়াবাদের সাধনা। লালনপন্থী বা বাউলদের সাথে এর কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। যদিও লালনের বাউলতত্ত¡ বৈষ্ণব ও সূফীবাদের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে। তবে তাতে সহজিয়া মতের সংশ্লেষ রয়েছে প্রবল। বাউলতত্ত¡ লালনের আবির্ভাবেরও একশ বছর পূর্বে ভারতবর্ষে আবির্ভূত হয়েছে। বাউলতত্তে¡ সাধন ভজনে নারীর সাহচর্য অপরিহার্য। সূফী বা মরমীয়াদের ক্ষেত্রে তা নয়। কিন্তু আত্মতত্ত¡ ও তত্ত¡জ্ঞানে সকলই অভিন্ন। লক্ষ্য ও গন্তব্য এক। দেহের বাইরে বাউলদের কোন সাধনা বা তত্ত¡ নেই। ‘যাহা আছে ভাÐে তাহা নাই ব্রহ্মাÐে’- দেহের বাইরে পাওয়া তাদের কাছে অনুমান, বর্তমান হচ্ছে দেহভাÐ। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর লোকায়ত দর্শনে উল্লেখ করেছেন, ‘যখন ব্রহ্মাÐ ও দেহভাÐ একই পদ্ধতি অনুসারে একই রকম উপাদানের সাহায্যে নির্মিত, উভয়ের মধ্যে একইভাবে নানা শক্তির খেলা হইতেছে, তখন দেহগত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে ব্রহ্মাÐের শক্তি তোমার অনুক‚ল সহায়ক হইবে। … এদেশের সিদ্ধগণ বলেন যে, মনুষ্য দেহের মতন পুর্ণাবয়ব যন্ত্র আর নাই; এমন যন্ত্র আর কেহ গড়িতে পারে না, এমন যন্ত্র নির্মাণ করাও মানুষের পক্ষে সম্ভব নহে। অতএব এই যন্ত্রস্থ সকল গুপ্ত এবং সুপ্ত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে, অন্য কোন স্বতন্ত্র যন্ত্র ব্যতিরেকে তোমার বাসনা পূর্ণ হইতে পারে।’ বাউলদের সাধনা বর্তমানের সাধনা; অনুমান তাঁরা মানেন না। ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে/ পাবি রে অমূল্যনিধি বর্তমানে/… শুনি ম’লে পাবো বেহেস্তখানা/ শুনে তাতো মন মানে না/ বিশ্বাসীদের দেখাশুনা এই ভুবনে।’ হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, ‘আস্সালাতু মেরাজুম মোমেনিন’- সালাত বা নামাজের মধ্যেই আল্লাহর সাথে বান্দার মেরাজ বা দেখা হবে। বাউলতত্তে¡র সাথে ইসলামের মূলের গভীর সংযোগটি এখানেই।
রুমী আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের যেমনি বিরোধীতা করেছেন, পাশাপাশি জাতিভেদ ও ছুতমার্গের বিরোধীতা করেছেন। সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানবমহিমা বোধের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কবিতায়। আমাদের বাউল-সাধকদের চিন্তা ও কর্ম এ দর্শনেই বিকশিত হয়েছে- সমৃদ্ধ হয়েছে। তার সাথে আরো যুক্ত হয়েছে বৈষ্ণব চেতনা ও শ্রী চৈতন্যের ভক্তিবিপ্লব। লালন সাঁই বলেছেন-
কেউ মালা কেউ তসবীহ্ গলে
তাতেই কী জাত ভিন্ন বলে?
যাওয়া কিংবা আসার কালে
জাতের চিহ্ন রয় কার রে?
ভারতবর্ষে কুলীন হিন্দু ব্রাহ্মণেরা জাতপাতের ধুয়ো তুলে বর্ণপ্রথায় নিম্নবর্গের মানুষদের যখন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, বৌদ্ধরা যখন বুদ্ধের অষ্টমার্গ থেকে বিপথগামী হয়ে মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে অন্যদিকে মুসলমানরা ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে আঁকড়ে ধরে আশরাফ-আতরাফ দ্ব›েদ্ব ইসলামের সাম্যকে জলাঞ্জলি দিয়েছে তখনি এখানে সুফীবাদের যেমনি প্রসার ঘটেছে মানুষের অন্তরে তেমনি ঠাঁই করে নিয়েছে বাউলদের মানবতাবাদী মানুষতত্ত¡। জালালুদ্দিন রুমীর মরমী দর্শন বাউলদের মানুষতত্ত¡ ও এই বাংলার ভাবসাধনাকে বুঝতে সাহায্য করবে। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে আরবে ওয়াহাবী মতবাদের সূচনা হলে ভারতবর্ষেও এর ঢেউ এসে বিদ্বেষ ও হিংসার বিস্তার ঘটাতে থাকে। ধর্মের নামে অধর্মের প্রতিষ্ঠা গুরুত্ব পেতে থাকে, ধর্ম মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু প্রেমের সোপানে কোনও জাত-পাত বা ধর্মভেদের জায়গা নেই। কোন শব্দ বা বাক্য দিয়ে তাকে স্পর্শ করা যায় না। দিওয়ান-ই-শামস গ্রন্থে রুমী বলেছেন-
প্রণয়ের পথে অন্তর আমাদের হারিয়ে গেছে;
বিশ্বে মতানৈক্যের সৃষ্টি করেছি আমরা।
মানুষের অন্তরে আমরা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছি,
আর প্রেমিকদের নিক্ষেপ করেছি অধৈর্যের মধ্যে।
সকল বিষয়-সম্পদ আমি পরিহার করেছি;
বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি।
আমার পিঠে একটা ভারী বোঝা ছিল,
আল্লাহ্কে ধন্যবাদ, সে বোঝা আমি ছুঁড়ে ফেলেছি।
প্রেমে সারাক্ষণ আত্মসমর্পিতা রাবেয়া বসরী আত্মবিভোরে প্রায়ই উচ্চারণ করেছেন, ‘হে আমার প্রভু, এই দুনিয়ার যতটুকু অংশ আমায় দিতে চাও তোমার শত্রæদেরই তা দান করো এবং পারলৌকিক জগতের যতটুকু অংশ তুমি আমাকে দান করবে, তা তোমার বন্ধুদের দিয়ে দাও। আমার জন্য তুমিই তো যথেষ্ট।’ রুমী বলেছেন-
গভীর গহন থেকে উঠে এলাম আমি ঊর্ধ্বলোকে
আমার সে মনোহর প্রেমাস্পদের সন্ধানে
আত্মার জগতে সে একজনের সাথে আমার ভালোবাসা ছিল;
এ জন্যেই আমি ফিরে গেলাম সেখানে,
যেখান থেকে আমি এসেছিলাম।
এই গভীর গহন থেকে উত্থিত হয়েই মানুষ ফেলে আসা সে মানুষকে খুঁজে বেড়ায়, আমি ফেলে আসা সেই আমিকে খোঁজে। জীবনব্যাপী খ্যাপার মতন এই খুঁজে ফেরা। আর যখন খুঁজে পান তখন যেমনি আত্মহারা হন, তেমনি অদৃশ্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আবার দৃশ্য অদৃশ্যে মিলায়। তখন সকল ব্রহ্মাÐ হয়ে ওঠে আমিময়। আর তখনি প্রেমিক, প্রণয়ের পাত্র ও প্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কোন কিছুরই তখন আলাদা কোনও অস্তিত্ব থাকে না। আর তাই রুমীর আহŸান গভীর গহন থেকে উঠে আসা সূর্যকিরণের মতো প্রজ্জ্বলিত, শাশ্বত। #

নার্সারীতে সফলতা পেয়ে নার্সারী নুরুল ইসলাম সাত বার অর্জন করেছেন জেলা প্রশাসনের সম্মাননা পদক

ফেইসবুকে আমরা

এ সম্পর্কিত আরো খবর...

error: Content is protected !!
error: Content is protected !!