পূজাপার্বণ এলেই জেগে ওঠে ঝিমিয়ে পড়া ঋষিপাড়া
পূজাপার্বণ এলেই কদর বেড়ে যায় ঢাক-ঢোল তৈরির কারিগরদের। একসময় বছরের পুরো সময়টাই তাদের ব্যস্ততায় কাটতো ঢাক-ঢোল তৈরিতে। এখন আর সে রকমটি নেই।
এখন এ কাজটি তাদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে বেছে নিয়েছেন নতুন পেশা। তবে এ শিল্পে জড়িত ঋষিপল্লীর ঢাক-ঢোল তৈরির কারিগরদের অনেকেই এখনো মনে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। তারা মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবারো নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে এ শিল্পটি। আবারো পুরোনো পেশায় ফিরে আসবেন ঋষিপল্লীতে এ পেশা ছেড়ে দেওয়া তাদের আপনজনরা।
কথাগুলো কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ঋষিপাড়ার ঢাক-ঢোল তৈরির শিল্পে জড়িত মানুষদের। তারা মনে করেন, সমাজে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব কিছুই ডিজাটাল হয়ে যাচ্ছে। বাদ্যযন্ত্রও এখন ব্যবহার হয় ডিজিটালভাবে। মানুষ এখন ঢাক চায়না ঢাকিও চায়না। তাই কদর কমতে শুরু করেছে হাতের তৈরি ঢাক-ঢোল, তবলা, খোলের। এখন যেন মানুষ এসব বাদ্যযন্ত্র শুধু বাসায় সাজিয়ে রাখতেই কিনে নিয়ে যায়।
তবে কোন উৎসব এলেই ঝিমিয়ে পড়া ঋষিপাড়ার মানুষজন যেন কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়। এ সময় ঢাক-ঢোলসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ভেসে আসে ওই পাড়া থেকে।
ঋষিপাড়ায় একসময় শতশত ঢাক-ঢোলের কারিগর ছিল। বাদ্যযন্ত্র তৈরি, মেরামত ও পূজাপার্বণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর আয় দিয়ে চলতো তাদের সংসার। কিন্তু সেই রমরমা দিনটি আর নেই। যান্ত্রিক বাদ্যযন্ত্রের দাপটে আজ কোণঠাসা তারা। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় ঋষিপাড়ার লোকজন ছেড়ে দিচ্ছেন পূর্বপুরুষের পেশা। বেছে নিচ্ছেন অন্য পেশা।
ঋষিপাড়ার প্রবীণ কারিগর সুরমিত চন্দ্র ঋষিমনি বলেন, একসময় আমাদের এ পাড়ায় কাকডাকা ভোর থেকে শুরু হতো ঢাক-ঢোল তৈরির কাজ। আয়-রোজগার ভাল ছিলো। ঢাক-ঢোল বিক্রিও ছিলো দারুণ। কিন্তু দিন যতই গড়াচ্ছে, আমাদের কষ্টের মাত্রাও বাড়ছে। এখন শুধু অপেক্ষা করি বছরে কয়েকটি বড় পূজা-পার্বণের জন্য। আর তাই করে এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে রয়েছি। আয় রোজগার না থাকায় আমাদের ছেলেরা এখন আর এ পেশাতে আগ্রহী না, তারা এ কাজ শিখতেও চায়না।
ঋষিপাড়ার এখনো অনেক পরিবার নিয়মিত ঢাক-ঢোল তৈরি করছেন। তাদের কাছে পাওয়া যায়, আম গাছের তৈরি ঢাক-ঢোল, তবলা, খোলসহ নানা ধরণের দেশীয় বাদ্যযন্ত্র। আকার ও গুণগত মান হিসেবে এসব বাদ্যযন্ত্রের দরদাম ধরা হয়। ঋষিপাড়ায় ঢাক-ঢোল বিক্রি হয় ৮ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। খোল বিক্রি হয় ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। আর তবলা ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা।
পূজোর শেষ সময়ে বেশ কিছু অর্ডার পেয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন সুবল ঋষিমনি। কারণ, পূজা শুরুর আগেই শেষ করতে হবে সবকাজ। অনেকে আবার মণ্ডপে বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন। তারাও দলবল নিয়ে নিয়মিত দিচ্ছেন মহড়া। সবমিলিয়ে দুর্দিনেও একটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে ঋষিপাড়ায়।
সুবল ঋষিমনি বলেন, এখান থেকে সারা দেশে পাঠানো হতো ঢাকঢোলসহ দেশি বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু কালের বির্বতনে হুমকির মুখে তাদের পেশা। বর্তমানে বিশ-পঁচিশটি পরিবার টিকিয়ে রেখেছে তাদের বংশপরম্পরার পেশাটিকে।
এখানের অর্জুন ঋষিমনি বলেন, ছোট থেকে বড় হয়েছি এ কাজ দেখে। আগে যতটুকু জমজমাট ছিলো এখন সেটি নেই বললেই চলে। আমি বাবার সাথে থেকে কাজটি শিখছি। কিন্তু ভবিষ্যতে কতটুকু সফলভাবে পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে পারবো, সেটি নিশ্চিত না।