নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন- অনৈক্য বিভেদে ফের প্রতীক নিয়ে শঙ্কা, সবাই চায় মনোনয়ন !
সুমন মিয়া – সোনারগাঁ প্রতিবেদকঃ প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে শুরু হয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আমেজ । প্রাচীন কাল থেকেই সোনারগাঁ অঞ্চলটি রাজনৈতিক ভাবে বেশ সমৃদ্ধ। মুঘল আমল, সুলতানি আমল এবং বৃটিশ শামনালে সোনারগাঁয়ের ভৌগলিক রাজনীতি পুরো পূর্ববঙ্গকে প্রভাবিত করেছে। বর্তমানে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত প্রাচীন ঐতিহ্যের এ সোনারগাঁয়ে নির্বাচনী হাওয়া বৈতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে শাসক দল আওয়ামীলী ও অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রস্তুতিও চলেছে জোড়েশোরে। বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট ও মহাজোটগতভাবে নির্বাচন হয়েছে। গত দুটি নির্বাচনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হলেও আগামী নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ চায় দলীয় প্রার্থী। তবে ছাড় দিতে নারাজ জাতীয় পার্টি। বিএনপি ব্যস্ত আসনটি পুনরুদ্ধারে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনে বিভিন্ন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এখন দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং এলাকায় গণসংযোগসহ বিভিন্নভাবে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই নির্বাচনকে টার্গেট করে বর্তমানে নানামূখী সমীকরণের মধ্যে আছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। রাজধানীর সবচেয়ে নিকটবর্তী জেলা হিসেবে সব রাজনৈতিক দলেরই এই জেলার ওপর আছে একটি আলাদা দৃষ্টি। নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং ঐতিহ্যের দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনটি। তাই আগামী নির্বাচনে এই আসন থেকে কারা কারা প্রার্থী হচ্ছেন তা নিয়েই ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা কল্পনা। শুরু হয়েছে নানান রকম হিসাব নিকাশ ও বিশ্লেষণ।
টানা দ্বিতীয় বারের মত নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে মহাজোটের শরীকদল জাতীয় পার্টির এমপি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মূলত এই আসনটি আওয়ামী লীগের আসন হিসেবে পরিচিত থাকলেও বরাবরই মহাজোটের শরীকদল জাতীয় পার্টির কাছে তুলে দেয়া হচ্ছে। যেটা আওয়ামীলীগের তৃণমূলের নেতারা কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারছে না। স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতারা দলের হাইকমান্ডের কাছে বরাবরই দাবি জানিয়ে যাচ্ছে এই আসনটি যেন আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী করে আবারও ফিরিয়ে দেয়া হয়।
সূত্র জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনে জাতীয় পার্টির কাছে থেকে আসনটি পুনরুদ্ধারে সোনারগাঁ থানা আওয়ামীলীগ ও সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারা উদগ্রীব থাকলেও অনৈক্য ও ভেদাভেদে জড়িয়ে থাকার কারণে ফের আসনটি পুনরুদ্ধারে রয়েছে শঙ্কা। যার অন্যতম কারণ দলীয় প্রতীক নিশ্চিতকরণে সোনারগাঁয়ের স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের মধ্যে অনৈক্য। বরাবরই বিভিন্ন সভা সমাবেশে ঐক্যের সুর তুললেও সেই সুরে এক হতে পারছে না সোনারগাঁয়ের আওয়ামীলীগ নেতারা। তাদের অনৈক্য বিভেদের ফলে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতে সক্রিয় না থাকায় দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতে ছিঁটকে পরে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী আওয়ামীলীগ নেতারা । কারণ এখনো সোনারগাঁয়ের আওয়ামীলীগ নেতারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতিতে সক্রিয় না হতে পারার ফের সোনারগাঁয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে শঙ্কা তৈরী হয়ে আছে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ আবারও জাতীয় পার্টির সাথে মহাজোট গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনে আসলে ফের তাদের অনৈক্য বিভেদের জেরে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে নৌকা হারাতে পারে সোনারগাঁ আওয়ামীলীগ।
সোনারগাঁ থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি সামছুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং সাধারণ সম্পাদক কায়সার হাসনাত ও সিনিয়র সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান মাসুম এই প্রধান তিন নেতাকেই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়েছেন এমনটাই স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের মধ্যে আলোচনা চলমান রয়েছে। যার কারণে সংগঠনকে গোছানোর ক্ষেত্রে নেই কোন তোড়জোড় থানা আওয়ামীলীগের নেতাদের। এছাড়া তাদের নেতৃত্বের উপর অসন্তোষ থানা আওয়ামীলীগের বেশকয়েকজন নেতা।
এরমধ্যে অন্যতম হল থানা আওয়ামীলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালাম। কারণ প্রায় সময়ই তাদের নেতৃত্বে গড়িমসির ও সংগঠনকে শক্তিশালী করায় স্থবীরতা নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন। তবে থানা আওয়ামীলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালামের সাথে বর্তমান নেতৃত্বে থাকা থানা আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের সাথে রয়েছে চরম বিরোধ। কিন্তু এ বিরোধ নিরসন না হলে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিপত্তি ঘটার শঙ্কা রয়েছে।
অপরদিকে জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ড. আবু জাফর চৌধুরী বিরুর সাথে থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সাংসদ কায়সার হাসনাতের রয়েছে চরম আঁকারে বিরোধ। তাদের বিরোধের চিত্র সোনারগাঁ থানা আওয়ামীলীগের সম্মেলন ও ইউনিয়ন সম্মেলনে ফুঁটে উঠে। কারণ থানা আওয়ামীলীগের সম্মেলনে ড. আবু জাফর চৌধুরী বিরুর সমর্থক ও কায়সার হাসনাতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এছাড়া জামপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সম্মেলনে এই দুই নেতাদের সমর্থকদের মধ্যে স্লোগান দেয়া নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তাদের এই বিরোধের প্রভাব আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
যার কারণে নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনে অনৈক্য বিভেদের ফলে ফের প্রতীক নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এ আসনে এবারও কি মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে শরিক দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী মনোনয়ন পাচ্ছেন, না আওয়ামী লীগের প্রার্থীই মনোনয়ন পাচ্ছেন, এ নিয়ে চলছে নানামুখী গুঞ্জন ও আলোচনা। তবে এ আসনের বর্তমানে সংসদ সদস্য হলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে ছেড়ে দেওয়ায় জাতীয় পার্টি প্রার্থী বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।আগামী নির্বাচনেও তিনি বেশ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে থাকবেন বলে জানান জাতীয় পার্টির অনেক নেতাকর্মী। অন্যদিকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মনে করছেন সুষ্ঠু পরিবেশে ও নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট হলে এ আসন থেকে বিপুল ভোটে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী এলাকায় আলোচনা সভা, মিটিং, মিছিল, সামাজিক কার্যক্রম ও বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণসংযোগ করছেন।
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনটি ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁ নামে একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত হয়েছে। এটি ২০৬ নির্বাচনী এলাকা। এ আসনে বর্তমান ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৫২ জন।নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে ১৯৭৩ সালে মোবারক হোসেন, ১৯৭৯ সালে কৃষক শ্রমিক পার্টি থেকে এ এস এম সোলাইমান, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মোবারক হোসেন, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে আবু নুর মোহাম্মদ বাহাউল হক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে নির্বাচিত হন বিএনপির রেজাউল করিম। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল কায়সার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ এ আসন মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। তাই জাতীয় পার্টির প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা এ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মহাজোটের জাতীয় পার্টির প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালে প্রায় ৯০ হাজার ভোটের ব্যবধানে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল কায়সার জানান, এ মুহুর্তে সোনারগাঁ আওয়ামীলীগে কোন কোন্দল নেই। একটি আসনে একাধিক ব্যাক্তি মনোনয়ন চাইতে পারেন। এটা নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। দেশের অনেরক আসনেই একাধিক ব্যাক্তি দলীয় মনোনয়ন চা্ন এটা দোষের কিছু না। একটি মহল সব সময় প্রচার করে বেড়ায় সোনারগাঁ আওয়ামীলীগে কোন্দল রয়েছে। এটা বলে এ আসনটিতে মহাজোটকে সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করে দেয়া হয়। তবে দ্ভাদশ সংসদ নির্বাচনে এ আসনে নৌকার মনোনয়ন আসবে বলে তিনি আশাবাদ বক্ত্য করেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য যারা মাঠে নেমেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল কায়সার, সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সামসুল ইসলাম ভূঁইয়া, সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান মাসুম, এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম মোবারক হোসেনের পুত্র ও মোবারক হোসেন স্মৃতি সংসদের চেয়ারম্যান এরফান হোসেন দীপ, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খ্যাতনামা অর্থপেডিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জাফর চৌধুরী বিরু, সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নব গঠিত কমিটির ১নং সদস্য মাহফুজুর রহমান কালাম, আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সদস্য কৃষিবিদ দীপক কুমার বণিক (দীপু) ও সাবেক ছাত্রনেতা এ এইচ এম মাসুদ দুলাল, সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য মারুফুল ইসলাম ঝলক, সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ৷
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপি মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন- বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মো. রেজাউল করিম, সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি অধ্যাপক ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বকুল ও সোনারগাঁ থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি খন্দকার আবু জাফর।এ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- বর্তমান সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মোহম্মদ এরশাদের পালিত কন্যা ও জাতীয় পার্টির নেতা অনন্যা হোসাইন মৌসুমী এবং রওশন এরশাদের রাজনৈতিক উপদেষ্টা গোলাম মশিহ। #