শিরোনাম
বাংলা সনের জন্ম কথা নববর্ষের ইতিহাস – এড.মাহবুবুর রহমান ইসমাইল
এড.মাহবুবুর রহমান ইসমাইলঃ শুভ নববর্ষ আমাদের প্রাণে এক নতুন আনন্দের বার্তা স ালিত হয়। হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হয় বন্ধুত্বের অবগাহন। চলতি ২০২৩ খ্রীঃ বাংলার সনের বয়স ৪৬৬ বছর, অনেকের কাছে প্রশ্ন জাগতে পারে সনের আবার বয়স কেমন করে হয়। আমাদের চারপাশে একদল লোক আছে তারা না জেনে না বুঝে আমাদের প্রজন্মকে ভুল বুঝাতে অযথা নববর্ষের আয়োজন অনুষ্ঠানের ভুল ব্যাখ্যা প্রচার করে থাকেন। একারণেই বাংলা নববর্ষের জন্মকথা আমাদের সকলেরই জানা দরকার। ভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লা বলেছেন, আমরা হিন্দু বা মুসলিম যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি ।
এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় এমন ছাপ মেরে দিয়েছে, যে তা-মালা, তিলক, টিকিতে, কিংবা টুপি, লুঙ্গি ও দাঁড়িতে ঢাকবার জো’টি নেই। ১৫২৬ খ্রীঃ থেকে ১৭০৭ খ্রীঃ পর্যন্ত ১৮১ বছর ভারতে মূঘল শাসন আমল ছিল। ১৮ জন মুঘল শাসক এর মধ্যে ১৫৫৬ সনে তৃতীয় তম স¤্রাট আকবরের রাজ্য শাসনে ৩০ বছর অতিবাহিত হলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অ লে খাজনা আদায় ও দরবারের কার্য পরিচালনায় সন তারিখের হিসাব নিয়ে ভীষন বিদঘুটে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারন ভারত বর্ষে তখন নানা প্রকার সনের প্রচলন ছিল, যেমনঃ ভারত সন, বিক্রম সন, শালীবাহন সন, জালালী সন, গুপ্তাব্দ, লক্ষন সন ইত্যাদি আর এদের অধিকাংশই ছিল চন্দ্র সন। চন্দ্র মাসে ৩০টি তিথি থাকে, তিথি গুলির প্রত্যেকটিকে এক একটি চান্দ্র দিন বলা হয়ে থাকে। এক পূর্নীমা থেকে অন্য আমাবস্যা অথবা এক অমাবস্যা থেকে অন্য পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়ের নাম চন্দ্র মাস। চন্দ্রের বর্ষ পরিক্রমার হিসাব অনুযায়ী চন্দ্র সন গণনা করা হয়। সাধারণত ৩৫৪ দিন ৯ ঘন্টায় এক চন্দ্র বৎসর হয়। আরবী হিজরী সনও এইরুপ একটি চন্দ্র সন। হযরত মোহাম্মদ (স.) কূরাইশদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজ জন্মভ‚মি মক্কা নগরী ছেড়ে মদিনাতে প্রত্যাবর্তন করেন। মক্কা থেকে মদীনা অভিমুখে এই অভিযাত্রা বা প্রত্যাবর্তনকে আরবী ভাষায় হিযরত বলা হয়ে থাকে। নবীর হিযরতের স্মৃতি রক্ষার্থে এই সন প্রচলন হওয়াতে তাকে হিজরী সন বা আরবী সন বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে সূর্যের বার্ষিক গতি অনুযায়ী সৌর সন গণনা করা হয়ে থাকে। সূর্যের রাশী চক্র অতিক্রমের সময় লাগে ৩৬৫.৬ ঘন্টা অর্থাৎ চন্দ্র সন থেকে সূর্য সন ১১ দিন বেশী।
মোঘল আমলে রাজ দরবারে হিজরী সনের প্রচলন ছিল। এই হিজরী সন অনুযায়ী কোন নির্দিষ্ট দিনে প্রজাদের খাজনা পরিশোধের দিন ধার্য্য করে দিলে প্রতি বারই এই সন সরে যেতে থাকে, অথচ ফসল তোলার সময় বা প্রাকৃতিক ঋতু সরে যায় না। যার কারণে প্রজাদের খাজনা আদায় ও দরবারে কার্য পরিচালনার দিন তারিখ নিয়ে বিভ্রাট সৃষ্টি হয়। এই জটিলতা দূরিকরণে সম্রাট আকবরের রতœ সভা সদস্য ফতেউল্লাহ কে হিজরী সন, ফসলী মৌসুম এবং ভারতে প্রচলিত নানা প্রকার চান্দ্র সনের সমন্বয়ে একটি সৌর সন তৈরির নির্দেশ দেন। আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর এমন একটি ত্রæটিমুক্ত ও বিজ্ঞান সম্মত সৌরসনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্যই একটি সাবলিল সুন্দর সন হতে পারে। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের হিজরী সন ছিল ৯৬৩ সন। এই হিজরী সনকেই সৌর সনে পরিবর্তন করে বাংলা সনের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। যার কারনে বাংলা সন পর্যায়ক্রমে গণনা শুরু হয় ৯৬৪, ৯৬৫ এভাবে আজ ১৪২৯ সন। বাংলা সনের বৈশিষ্ট এই যে, এখানে সৌর জন ও চন্দ্র সম্মিলিত হয়ে এক অভিনব সনের জন্ম দিয়েছে। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের কাল ১৫৫৬ ইংরেজী সন। চলতি ইংরেজি সন ২০২৩ থেকে ১৫৫৬ বছর বাদ দিলে (২০২৩-১৫৫৭) = ৪৬৬ বছর আর এর সঙ্গে হিজরী ৯৬৩ যোগ দিলে ৯৬৩+৪৬৬ = ১৪২৯ বাংলা সন। আরেকটি ব্যাপার হলো ইংরেজীতে সৌর সন ১৪ এপ্রিল এর সঙ্গে বাংলা সনের প্রথম তারিখ ১লা বৈশাখকে এমন অপরূপ সমন্বয় করা হয় যে, বাংলা সন ঘুরে-ফিরে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিলে শুভ নববর্ষ পহেলা বৈশাখ এসে মিলন ঘটাবে। ইংরেজি ১৫৫৬ সন এবং আরবি সন হিজরী ৯৬৩ সন থেকে বাংলা সনের পদযাত্রা শুরু। বাংলা ভাষা যেমন আমাদের সম্পদ তেমনি বাংলা সন এবং নববর্ষও আমাদের জাতীয় সম্পদ।
পৃথিবীর যে কোন জাতির পূর্ণাঙ্গতার স্বীকৃতির অন্যতম উপাদান হচ্ছে তার নিজস্ব দিন পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার। আমাদের অহংকার এই বাংলা সন, যার নববর্ষের সুতায় বাঙালী জাতিকে বেঁধে দিয়ে এক্ষেত্রে শাহেনশাহ্ আকবর চিরদিন বাঙ্গালী জাতির কাছে অ¤øান হয়ে আছে। বাংলা সন হলো আমাদের জাতির একটি অলংকার, যা আমাদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, একে যারা টেনে তুলতে চান তারা হয়তো বাংলা সনের ইতিহাস জানেন না অথবা তারা মানব সভ্যতার ইতিহাসকে টেনে ছিঁড়ে ফেরত চায়। মানুষের হৃদপিন্ড ছিড়ে ফেললে মানুষ বাঁচে না, মানুষ মরে যায়। ঠিক তেমনি বাঙালী জাতির সংস্কৃতির হৃদপিন্ড ছিঁড়ে ফেললে বাঙালী জাতি মরে যাবে শুভ নববর্ষ ।
এড.মাহবুবুর রহমান ইসমাইল রাজনৈতিক ও লেখক।