বুয়েট ছাত্র পরশকে হত্যা করে সিটি শাহীন সহ মাদক ব্যাবসায়ীরা | পিটিয়ে হত্যা
নারায়ণগঞ্জে খবর ডেস্কঃ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নতুন মোড় নিচ্ছে। পেশাদার মাদক কারবারিদের হাতে ফারদিন খুন হয়েছেন বলে তথ্য মিলেছে। এই নিয়ে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত হুবহুব খবরটি নারায়ণগঞ্জের খবর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।গত ৪ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়ার রাতে ফারদিন কেরানীগঞ্জ, পুরান ঢাকার জনসন রোড এবং রূপগঞ্জ ও ডেমরাসংলগ্ন চনপাড়া এলাকায় অবস্থান করছিলেন। রাত ২টা ৩৫ মিনিটে তিনি ছিলেন চনপাড়া এলাকায়। সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, প্রযুক্তিগত তদন্ত ও স্থানীয় সূত্র সমকালকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।প্রযুক্তিগত তদন্তে উঠে এসেছে, নিখোঁজ হওয়ার রাতে ফারদিন তাঁর বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাকে রামপুরায় নামিয়ে দেওয়ার পর আরেক বান্ধবীর সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন। ওই বান্ধবীর সঙ্গে রাত ১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত মেসেঞ্জারে কথা বলেছেন ফারদিন।সূত্র আরও জানায়, পরীক্ষার আগের দিন মধ্যরাতে ফারদিনের কেরানীগঞ্জ, জনসন রোড ও চনপাড়া যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করেছে একাধিক সংস্থা। তথ্য বলছে, মূলত মাদক কেনার জন্য ফারদিন কেরানীগঞ্জ ও জনসন রোডে যান। কয়েকটি জায়গায় কিনতে না পেরে শেষমেশ তিনি যান ডেমরা সংলগ্ন চনপাড়ায় পূর্বপরিচিতদের কাছে। সেখানে ফেনসিডিল কেনার চেষ্টা করেন তিনি। ফেনসিডিলের দরদাম নিয়ে চনপাড়া এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি শাহীন ওরফে সিটি শাহীন ও তার লোকজনের সঙ্গে ফারদিনের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আট-দশজন মিলে ফারদিনকে বেধড়ক পেটায়। পরে ওই রাতেই শাহীন ও তার লোকজন ফারদিনের নিথর দেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।র্যাব ও পুলিশ আলাদাভাবে গতকাল বৃহস্পতিবার চনপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়েছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল রাত ১১টার দিকে সমকালকে জানান, চনপাড়ায় মাদকের স্পটে বৃহস্পতিবার র্যাব-১ এর একটি দল অভিযান চালায়। এ সময় মাদক কারকারিরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় সিটি শাহীন নামে এক মাদকের গডফাদার গুলিবিদ্ধ হয়। তার বিরুদ্ধে মাদক, হত্যাসহ ২৩টি মামলা রয়েছে। আহত অবস্থায় শাহীনকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চনপাড়ার অভিযানে র্যাবের পাঁচ সদস্য আহত হয়েছেন। র্যাবের মুখপাত্র বলছেন, ফারদিনের ঘটনায় সন্দেহভাজনদের ধরতে গতকাল চনপাড়ায় ওই অভিযান হয়নি। আগে থেকে তাঁদের কাছে তথ্য ছিল, ওই এলাকায় মাদকের বড় চক্র সক্রিয়।গতকাল মধ্যরাতে জানতে চাইলে ডিবিপ্রধান ডিআইজি হারুন অর রশিদ সমকালকে বলেন, চনপাড়া এলাকায় ডিবির একটি টিম বৃহস্পতিবার গিয়েছিল। পরে তারা ফেরত এসেছে।এদিকে গত রাতে ফারদিনের বাবা ও মামলার বাদী কাজী নূর উদ্দিন রানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ফারদিনের যে স্বভাব-চরিত্র এবং যাদের সঙ্গে ওর মেলামেশা, তার তো চনপাড়ায় যাওয়ার কথা নয়। তাকে কখনও একটি সিগারেট ফুঁকতে দেখিনি। মাদকের স্পটে কেন গিয়েছিল- এ রকম কথা শুনতে খারাপ লাগছে। সব সময় টিউশনি-পড়াশোনা নিয়ে সে ব্যস্ত থাকত।আরেকটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, হত্যার সঙ্গে মাদক কারবারিদের যোগসূত্রের বিষয়টি সামনে আসার পর শাহীন ও তার লোকজনকে গ্রেপ্তারে একাধিক সংস্থা মাঠে নামে। এরই মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। ওই সূত্র বলছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে চনপাড়া এলাকায় মাদকের কারবারিরা সক্রিয় হয়। দীর্ঘদিন ধরে এমনটি হচ্ছে। স্থানীয় একজন প্রথম ফারদিন হত্যাকাণ্ডে শাহীনের সংশ্নিষ্টতার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়।ফারদিন হত্যার তদন্তে যুক্ত এমন এক কর্মকর্তা বলেন, চনপাড়ায় যার বাসার পেছনে নিয়ে মাদক কারবারিরা ফারদিনকে হত্যা করেছে, তার নাম-পরিচয় জানা গেছে। পুলিশকে ওই এলাকার এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, হত্যারপর নৌকা ভাড়া করে বুয়েট ছাত্রের লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে ওই নৌকার মালিককে খুঁজছে পুলিশ।ঘটনার রাত ১১টা ৯ মিনিটের পর ফারদিনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে অন্য কোনো ডিভাইস ব্যবহার করে আরেক বান্ধবীর সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলছিলেন ফারদিন। এর আগে ধারণা ছিল, বুশরার সঙ্গে ফারদিনের সর্বশেষ কথা হয়েছিল। তবে ওই রাতে ফারদিনের কাছে বুশরা জানতে চেয়েছিলেন, ঠিকঠাক বুয়েটের হলে পৌঁছেছে কিনা? উত্তরে ফারদিন ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিয়েছিলেন। ১১টার দিকে ফারদিনের সঙ্গে বুশরার মেসেজ আদান-প্রদান হয়। এর পরই ফারদিন আরেক বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেন।একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, ফারদিন হত্যাকাে তাঁর আরেক বান্ধবীর সংশ্নিষ্টতার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক ধারণা ছিল, হত্যার পর ফারদিনের লাশ কেরানীগঞ্জসংলগ্ন কোনো নদীতে ফেলা হয়েছে। তবে প্রযুক্তিগত তদন্তে ফারদিনের সর্বশেষ অবস্থান চনপাড়া এলাকায় নিশ্চিত হওয়ার পর গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা, চনপাড়াসংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীতে বুয়েট ছাত্রের লাশ ফেলা হয়। সর্বশেষ যে মাদক স্পটে ফারদিনের অবস্থান দেখা যায়, শীতলক্ষ্যা থেকে সে স্থান সামান্য দূরে।ফারদিনের স্পেন যাওয়া উপলক্ষে ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় ডিবেটিং সোসাইটির একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ওই বৈঠকে ফারদিনের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। তবে বৈঠকে উপস্থিত না থেকে ফারদিন তাঁর বান্ধবী বুশরাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। বৈঠকে ফারদিনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বুয়েটের তাঁর সিনিয়র ভাই শীর্ষকসহ কয়েকজন। এরই মধ্যে শীর্ষককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।আরেক দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ফারদিনের মাদক সেবনের বিষয়টি বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবী আগে থেকে জানতেন। ঘটনার রাতে তিনি হলে ফিরবেন- এটাও কেউ কেউ জানতেন। ওই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, উদ্ভাস কোচিং এবং ডিবেটিং সোসাইটির সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকায় ফারদিনের সঙ্গে অনেকের যোগাযোগ ছিল। কারও কারও সঙ্গে ফারদিন প্রায় রাতেই মেসেঞ্জারে চ্যাট করতেন। ডিবেটিং সোসাইটিতে গিয়ে বুশরার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। চার বছরের বেশি সময় ধরে পরিচয় থাকলেও তাঁদের মধ্যে পরস্পর মোবাইল ফোন নম্বর আদান-প্রদান হয়নি। মেসেঞ্জারে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ হতো। সব মিলিয়ে চারবার তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছে। সর্বশেষ ৪ নভেম্বর তাঁরা একসঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন। বুশরা যতক্ষণ তাঁর সঙ্গে ছিলেন গান শুনেছেন।প্রযুক্তিগত তদন্তে যুক্ত উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফারদিনের অবস্থান কেরানীগঞ্জে ছিল; এর পর জনসন রোড। সেখান থেকে যান চনপাড়ায়।ফারদিনের বান্ধবী বুশরা রিমান্ডে :এদিকে বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যার ঘটনায় করা মামলায় আমাতুল্লাহ বুশরাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত রিমান্ডের আদেশ দেন। এ ছাড়া মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব রামপুরা থানা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ৪ নভেম্বর ডেমরার শান্তিবাগ এলাকার বাসা থেকে বুয়েটের উদ্দেশে বের হন ফারদিন। ওই দিন তিনি বাসায় না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ফারদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। এমনকি পরদিনের একটি পরীক্ষায় অংশ নেননি। এ ব্যাপারে ৫ নভেম্বর রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা। ওই জিডিরপরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ফারদিনের বান্ধবী বুশরাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে বুশরা পুলিশকে জানান, ওই দিন বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে রাত পর্যন্ত ফারদিন তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরার পর রাত ১০টার দিকে রিকশায় রামপুরার টিভি ভবন এলাকায় তাঁকে পৌঁছে দিয়ে চলে যান ফারদিন। গত সোমবার বিকেলে ফারদিনের পরিবার জানতে পারে, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নৌ পুলিশ সদস্যরা ফারদিনের লাশ উদ্ধার করেছেন। এর পর ফারদিনের নিখোঁজ হওয়া ও হত্যার ঘটনায় বুশরার ইন্ধন রয়েছে উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে বুধবার রাতে রামপুরা থানায় মামলা করা হয়। গতকাল দুপুরে বনশ্রী এলাকা থেকে পুলিশ বুশরাকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে আদালতে হাজির করে রামপুরা থানা পুলিশ সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায়। শুনানি শেষে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। এ সময় বুশরার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।লাশ কীভাবে শীতলক্ষ্যায় এলো, খতিয়ে দেখা হচ্ছে- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী :ফারদিনের লাশ কীভাবে শীতলক্ষ্যায় এলো- বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বুয়েটের যে শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার সর্বশেষ অবস্থান আমরা গাজীপুরে পেয়েছিলাম। গাজীপুর থেকে পরবর্তী সময়ে কীভাবে এই নদীতে এলো; এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনার পেছনে যারাই জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।#